ক্রান্তিকালের পথিকৃৎ by সাগর লোহানী

১৯৫৫ সালের জুলাই মাস। রাজশাহী কারাগার থেকে মুক্তির পর কামাল লোহানী ফিরে এলেন পাবনায়। কিন্তু অভিভাবকদের সঙ্গে তার শুরু হলো রাজনীতি নিয়ে মতবিরোধ। অভিভাবকরা চাইছিলেন লেখাপড়া শেষে রাজনীতি করো, আপত্তি নেই। কিন্তু কামাল লোহানী তখন রীতিমতো রাজনীতি প্রভাবিত এবং মার্কসবাদের অনুসারী।


চোখে তার বিপ্লবের ঐশ্বর্য। আর তাই তিনি ছোট চাচা শিক্ষাবিদ তাসাদ্দুক লোহানীর কাছ থেকে মাত্র ১৫ টাকা চেয়ে নিয়ে অনিশ্চিতের পথে ঢাকা অভিমুখে পা বাড়ালেন। জীবনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করলেন। আর সেই সঙ্গে শুরু হলো তার নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সংগ্রাম।
কামাল লোহানী নামেই সমধিক পরিচিত হলেও তার পারিবারিক নাম আবু নঈম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী। পাবনার সনতলা গ্রামে ১৯৩৪ সালের ২৬ জুন জন্মগ্রহণ করেন।
১৯৫২ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। এরপর ভর্তি হলেন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে। কলেজে নির্বাচন এগিয়ে এলে সমমনা ক'জন এক হয়ে জোট বাঁধলেন, নাম দিলেন 'পাইওনিয়ার্স ফ্রন্ট' অর্থাৎ প্রগতিবাদী ছাত্র জোট। এই ফ্রন্টের সদস্যরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পর গড়ে ওঠা প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। এ ছাড়া তারা রাজনৈতিক সংগ্রাম ছাড়াও সে সময় সাংস্কৃতিক কাজে বেশ সক্রিয় ছিলেন। সুতরাং কামাল লোহানীও এর বাইরে রইলেন না।
১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠল। কামাল লোহানীর নামে জারি হলো হুলিয়া। ১৩ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে দৈনিক 'আজাদ' থেকে ঘরে ফেরার পথে গ্রেফতার হলেন তিনি। এই সময় ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের ২৬ নম্বর সেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, আবুল মনসুর আহমেদ, হায়দার আকবর খান রনো, অধ্যাপক রফিকুল ইসলামসহ অনেকেই একসঙ্গে ছিলেন। সাড়ে তিন মাস পর তিনি মুক্তি লাভ করেন।
১৯৬২ সালে স্বল্পকাল কারাবাসের পর কামাল লোহানী 'ছায়ানট' সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সাড়ে চার বছর এ দায়িত্ব পালন করেন। এরপর মার্কসবাদী আদর্শে ১৯৬৭ সালে গড়ে তোলেন 'ক্রান্তি'। ১৯৬৭ সালের ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর সম্মেলন হয় ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে। আয়োজন করেন গণসঙ্গীতের অনুষ্ঠান_ 'ধানের গুচ্ছে রক্ত জমেছে।' নাটক_ 'আলোর পথযাত্রী'; কামাল লোহানী পরিচালনা ও অভিনয় করেন এবং নৃত্যনাট্য_ 'জ্বলছে আগুন ক্ষেতে ও খামারে'_ বিবেকের ভূমিকায় নেচেছিলেন।
১৯৭০ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
একাত্তরে আমিনুল হক বাদশা অনেকটা 'হাইজ্যাক' করার মতো তাকে ট্যাক্সিতে উঠিয়ে নিয়ে যান বালীগঞ্জ সার্কুলার রোডে। সেখানে তখন আয়োজন চলছিল 'স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে'র ৫০ কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ ট্রান্সমিটার উদ্বোধনের। এ অনুষ্ঠানে কামাল লোহানী কাজী নজরুল ইসলামের 'বিদ্রোহী' কবিতা আবৃত্তি করেন।
সৈয়দ হাসান ইমাম 'সালেহ আহমদ' নামে সংবাদ পাঠ শুরু করেন। সাংবাদিক কামাল লোহানী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ বিভাগের দায়িত্ব নিলেন। এ বিভাগ সংগঠন করা ছাড়াও সংবাদ পাঠ, কথিকা লেখা ও প্রচার, ঘোষণা ইত্যাদিতে কণ্ঠ দিয়েছেন। বিদ্রোহী বেতারে সবাই কর্মী এবং প্রয়োজনে সবাইকে সবকিছুই করতে হয়।
১৯৭১ সালের ২৫ ডিসেম্বর তিনি দায়িত্ব নিলেন ঢাকা বেতারের। বিধ্বস্ত বেতারকে পুনর্গঠনে ব্রতী হন। ১৯৭৩ সালের ২০ জানুয়ারি আবার সাংবাদিকতায় ফিরে আসেন। যোগ দেন 'দৈনিক জনপদ' নামে একটি নতুন পত্রিকায়। তিনি ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হন।
১৯৭৭ সালের ৬ জানুয়ারি সরকার তাকে রাজশাহী থেকে প্রকাশিত 'দৈনিক বার্তা'র নির্বাহী সম্পাদক নিযুক্ত করে। ১৯৭৮ সালে তাকে সম্পাদক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।
১৯৮১ সালে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মতবিরোধ হলে 'দৈনিক বার্তা' ছেড়ে 'বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটে'র 'ডেপথনিউজ বাংলাদেশ'-এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ক'মাস পর তিনি পিআইবির অ্যাসোসিয়েট এডিটর পদে নিযুক্ত হন।
১৯৯১ সালে তিনি শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে মহাজোটের বিজয়ের পর আবার শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
কামাল লোহানী '৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি একুশে চেতনা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক, স্বাধীন বাংলা বেতার পরিষদের উপদেষ্টা, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উপদেষ্টা। ১৯৮৩ সালে কামাল লোহানী সরাসরি জড়িত হয়ে বাংলাদেশ গণশিল্পী সংস্থা গঠন করেন এবং গণশিল্পী সংস্থার সভাপতি হন।
তার লেখা 'আমাদের সংস্কৃতি ও সংগ্রাম', 'আমরা হারবো না' এবং 'লড়াইয়ের গান' গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে প্রকাশিত তার লেখা 'সত্যি কথা বলতে কি' এবং কবিতার বই 'দ্রোহে প্রেমে কবিতার মত' প্রকাশিত হয়েছে ২০১০ সালে। ২০১১ সালে প্রকাশ পায় 'সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও নৃত্যশিল্পের বিস্তার' ও 'রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীন বাংলা বেতার' বই দুটি। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি, এর প্রাসঙ্গিকতা ইত্যাদি বিষয়ে নিজের লেখার সংকলন 'শত্রু বধের উৎসবে' এবং বরণীয় ব্যক্তিত্বের প্রয়াণে নিজের লেখার সংকলন 'যেন ভুলে না যাই' বই আকারে প্রকাশ পাবে খুব শিগগির। তিনি বর্তমানে স্মৃতিকথা লেখায় নিজেকে ব্যাপৃত করেছেন।
বাংলা একাডেমী ফেলো কামাল লোহানী 'জাহানারা ইমাম পদক' পেয়েছেন ২০০৮ সালে। কলকাতা পুরসভার দ্বিশতবর্ষ সম্মাননা পেয়েছেন ১৯৯১ সালে। প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক সম্মাননা এবং রাজশাহী লেখক সংঘ সম্মাননাও পান তিনি। এ ছাড়া ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর 'ক্রান্তি স্মারক-২০০৩', ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর ঋষিজ সম্মাননা ও স্মারকসহ বহু প্রতিষ্ঠানের সম্মাননা তিনি পেয়েছেন।
মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর তিনি দ্বিতীয়বারের মতো শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
 

No comments

Powered by Blogger.