চারদিক-ছোট্ট এক রাজপুত্র ও ‘সিস্টেম’ by সাকিলা মতিন

দুষ্ট এবং শিষ্টের মধ্যে রীতিমতো লড়াই। লড়াই সৎ আর অসতের মধ্যে। সুন্দর এবং অসুন্দরের মধ্যে। ‘সিস্টেম’ এবং নিয়মের। প্রায়োগিক অর্থে সিস্টেম এক আর নিয়ম আরেক। নিয়ম ভেঙেই ‘সিস্টেম’। সরকারি অফিস থেকে শুরু করে ব্যাংক, আদালত, হাসপাতাল—সর্বত্রই এই সিস্টেমের মহামারি। যদিও এ সিস্টেমটা নিয়ম ভাঙার মহাপ্লাবন। তবু নাম তার ‘সিস্টেম’।


সিটিং সার্ভিস বাসে সিট নেই। তবু মন্দের ভালো একটা লাইন আছে। প্রথম যখন দৃশ্যটা চোখে পড়ল, অভূতপূর্ব অনুভূতি! সারি ধরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষমাণ যাত্রী। প্রত্যেকের মধ্যেই সহনশীলতা। শিক্ষিত ও সুসভ্য। কিন্তু সামান্য কদিন। এখানেও কালো থাবা সিস্টেমের। সিস্টেম করে যদি একটু আগে যাওয়া যায়, মন্দ কি? কী সেই সিস্টেম? হুড়োহুড়ি, ধাক্কাধাক্কি আর ল্যাং মারা। যেমন আরোহী, তেমনি হেলপার। সবার মাথায় একটাই চিন্তা—যদি কিছু লাভ হয়! স্থায়িত্ব কতটুকু এই লাভের? সে চিন্তা করার অবসর কই? বরং ব্যস্ততা সিস্টেমবাজিতে। আরোহী ভাবছে, যদি কিছু কম দেওয়া যায়! হেলপার ভাবছে, যদি কিছু উপরি পাওয়া যায়! মন্দ কি? চালক আর টিকিট চেকার ভাবছে অন্য কথা। লাভের ভাগ তো পাবেই!
অপেক্ষমাণ বাসযাত্রীদের বিশাল সারি। পেছনের লোক সিস্টেম বোঝে, তাই সামনে চলে যায়। আর সামনের লোক চলে যায় পেছনে। সিস্টেম না বোঝার অপরাধে। সত্যিই কি সে বোঝে না? নাকি বুঝতে চায় না? কিংবা হয়তো বা সিস্টেমে পড়তেই চায় না। কারণটা যা-ই হোক, মূল কথা হলো, এখনো এমন মানুষ আছে, যারা সিস্টেমবাজি করে না। সিস্টেমবাজিতে পড়ে না। সবাই ধরে নেয় এরা মাঝের মানুষ। গোবেচারা। না পারে বলতে, না পারে সইতে। এরা শুধু কষ্ট পায়। পিছিয়ে পড়ে। একেবারে হাসিমুখে। কিন্তু কত দিন? যদিও এ প্রশ্নটাও আর সব প্রশ্নের মতোই ক্লান্ত এবং বিমর্ষ। হবেই তো। উত্তর নেই যে!
প্রশ্ন আছে, উত্তর নেই। সত্য আছে, জানা নেই। নিয়ম আছে, মানা নেই। সুন্দর আছে, খোঁজ নেই। ক্ষোভ আছে, প্রতিবাদের ভাষা নেই। কিছুই কি নেই? কী আশ্চর্য! কেউ কিছু বলছে না। নিয়ম মেনে, মূল্যবোধকে আঁকড়ে ধরে, শিক্ষিত মানুষগুলো কুরে কুরে মরছে। জোর যার মুল্লুক তার। কিসের জোর? যোগ্যতার, নাকি সিস্টেমবাজির? এভাবে আর কত দিন? কত দিন আর নীরবে মেনে নেওয়া? মুখ বুজে সয়ে যাওয়া? ঘুণপোকা শব্দ করে কাটছে। কেউ কি শোনার নেই? কেউ কি দেখার নেই?
আছে। এই নগরেই, অসুন্দরের পাশেই সুন্দর আছে। ঘর থেকে বের হলে জ্যামের বাইরেও ছায়ার মতো খোলা আকাশ আছে। খোলা আকাশ#জুড়ে মেঘের খেলা আছে। গিজগিজ জনসংখ্যার ভিড়েই মানুষ আছে। পথের দুই ধারে ময়লা-আবর্জনার পাশে সবুজ অনেক গাছ আছে। গাছে টকটকে লাল ফুল আছে। জারুলের টকটকে বেগুনি রশ্মির আলোতে শুদ্ধতার পথ আছে। রাস্তার ধারে না খেয়ে থাকা ছোট্ট শিশুগুলোর মাঝে আজও শিশুসুলভ হাসি আছে। সিস্টেম মেনে নেওয়া মানুষের ভিড়েই নিয়মকে এগিয়ে দেওয়ার মানুষও আছে।
ঠিক যেন রূপকথার রাজকুমার। পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় চড়ে আগমন। দৈত্য-দানব, ভূত-প্রেতরা ভীতসন্ত্রস্ত। হাতে তলোয়ার নেই। আছে ছোট্ট একটা লাঠি। এই লাঠি ঘুরিয়েই রাজপুত্র শায়েস্তা করে সব দুষ্টলোকদের। কী করবে? রাজপুত্র যে বড় একা। কেউ শুনতে চায় না তার কথা। অবশ্য সত্যের পথে একাই চলতে হয়। তার ওপর রাজপুত্র আবার অর্থহীন। অর্থাৎ গরিব। সামান্য টিকিট বিক্রেতা। সব মিলিয়ে মাসে আয় তিন হাজার ২০০ টাকা। মা, বাবা, দুই ভাই আর এক বোনের সংসার। পরিবারে সবার ছোট। বয়স মাত্র ১৫। আগে মৌচাক মার্কেটের একটি দোকানে কাজ করত। দেশের বাড়ি বরিশাল। ঢাকায় থাকে মালিবাগে। প্রতিদিন আট ঘণ্টা টিকিট বিক্রি করে। জীর্ণতার ছাপ স্পষ্ট। অভাবকে ফাঁকি দিয়ে ক্লান্তিতেও হাসিমুখ। সাধারণ আর দশজন মানুষের মতো দিন আনে দিন খায় পরিবারের মতোই ওর জীবন। তবে কেন গল্প বলা? রূপকথার রাজপুত্র হওয়া?
রাজপুত্রের নাম ‘সুমন’। দিবানিশি বাসের ধানমন্ডি রাপা প্লাজার কাউন্টারের টিকিট বিক্রেতা। কিছুদিন আগে মালিক পরিবর্তন হওয়ার সময়ে ঢুকে পড়েছিল ‘সিস্টেমবাজি’। কাউন্টার থেকে যাত্রী না নিয়ে রাস্তা থেকে লোক ওঠানোতেই অনেকের আগ্রহ ছিল বেশি। তথাকথিত শিক্ষিত মানুষগুলোও সুযোগ নিত। অযথাই ধাক্কাধাক্কি, ঠেলাঠেলি। প্রায় লোকাল বাস হতে হতেও হচ্ছে না। শুধু সুমনের সাহসী উদ্যোগের কারণে। রীতিমতো লড়াই। মাঝেমধ্যে কাউন্টারে থামত না বাস। দমার পাত্র নয় সে। চড়ে বসত বাসে। পুরোদমে চলত টিকিট বিক্রি। লাইন ভেঙে কারও আগে যাওয়ার সুযোগ নেই। সুমনের হাতে লাঠি। সঙ্গী শুধু বন্ধু মনির। চেষ্টার ত্রুটি নেই। অন্তত রাপা থেকে পান্থপথ, কোথাও কোনো সিস্টেম নেই। আছে নিয়ম। হোক না পথটা অল্প। তবু পরিষ্কার তো!
সাকিলা মতিন

No comments

Powered by Blogger.