মুকুলের চরমপত্র-চরমপত্রের মুকুল by শামীম মমতাজ

৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি দিনের ৮ থেকে ১০ মিনিটের ছোট্ট এক কথিকা 'চরমপত্র' ছিল One Man Army বিশাল 'ওয়ার ফ্রন্টের' একেকটি অ্যাটম বোম। 'চরমপত্র' ছিল মুকুলের ক্ষুরধার কলমযুদ্ধ ও অসাধারণ বাকযুদ্ধের এক অপূর্ব সমন্বয়। চরমপত্রের কণ্ঠের শব্দের জাদুর বাঁশি জয় করেছিল এক মহাযুদ্ধ- মুক্তিযুদ্ধ।


যা শুনে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলার লক্ষ দামাল ছেলে হাসিতে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে অর্জন করে আনল স্বাধীনতা- এখানেই বাংলার জয়, বাঙালির জয়- চরমপত্রের মুকুলের বিজয়। এম আর আখতার মুকুল বিজয় দেখেছেন- স্বাধীনতা এনেছেন। এভাবেই তিনি ৯ মাসে পৌঁছে যান কোটি বাঙালির হৃদয়ে। এই হলো সংক্ষেপে মুকুলের চরমপত্রের কাহিনী।
'মুকুলের চরমপত্র না চরমপত্রের মুকুল' এই দুটি ধারা এসে আজ মিলেছে একই স্রোতে। বাংলার পাঠকরা তাই বারে বারে ভিজেছেন এই দুই সুরের ঝরনাতলায় এসে। তাদের অন্তহীন প্রশ্ন ও প্রত্যাশার জবাবে বলছি, 'চরমপত্রের মুকুল' হওয়ার জন্য তাঁকে অনেক দীর্ঘ বন্ধুর পথ, চড়াই-উতরাই, উত্থান-পতন ও প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে সাহসে পাড়ি দিতে হয়েছে। শুরুটাই ছাত্রজীবন থেকেই বেপরোয়া, অপ্রতিরোধ্য, দুঃসাহসী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে ভালোবাসতেন। জাঁদরেল পুলিশ অফিসার বাবার রক্তচোখ উপেক্ষা করে দু-দুবার বাড়ি থেকে পালানোর মধ্য দিয়েই জীবনের প্রথম পাঠ শুরু। ১৯৪৮-৪৯ সালে ছাত্রাবস্থায় রাজবন্দি কারাবন্দি থেকেই স্নাতক পরীক্ষায় পাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের ছাত্র থাকাকালে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' কণ্ঠে ও হৃদয়ে এই ছিল ব্রত। কিন্তু কখনো রণে ভঙ্গ দিয়ে পিছপা হননি। ফলে বিজয়ের মুকুটে যোগ হয়েছে একের পর এক পালক- শেষ অবধি 'স্বাধীনতা পুরস্কার'।
ইনি হচ্ছেন এম আর আখতার মুকুল- যদিও কোনো নির্দিষ্ট সময় বা কালের মানুষ নন, একাত্তর এসে মুকুলের জীবনের রং বদলে গেল। শুধু মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসের মাঝে তাঁর পুরো পরিচয় পাওয়া যাবে না, তাঁকে ইতিহাসের পাতার কোনায়, স্বাধীনতা দিবসের আনন্দ মেলায় অথবা বিজয় দিবসের উৎসবের সময়ে গণ্ডিতে তাঁকে মাপা বা তাঁর সন্ধান যথার্থ হবে না। তাঁর অসাধারণ সৃষ্টিকর্ম, কলমের ধারালো লেখনী, সাহসী বক্তব্য, দুঃসাহসিক সাংবাদিকতা-আপসহীন রিপোর্টিং, নিরপেক্ষ কলম, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াকু এক যোদ্ধা হিসেবে মুকুল বরণীয় হয়ে থাকবেন বহু শতাব্দী ধরে।
প্রকৃতিতে যেমন বর্ষা-বসন্ত গ্রীষ্ম আসে, তেমনি মুকুলের লেখার সৃষ্টিতে এসেছিল রাজনৈতিক সততার কথা- দেশদ্রোহীদের বিরুদ্ধাচরণ। দুর্বার অপ্রতিরোধ্য সৈনিক মুকুল জীবনের শেষ দিনটিতেও লিখে গিয়েছেন বহুসংখ্যক গ্রন্থ, ইতিহাসভিত্তিক রচনা, গবেষণা বিষয় ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।
মুক্তিযুদ্ধের রক্তে স্নাত বাংলায় স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারদের গাড়িতে জাতীয় পতাকার ঘৃণিত দৃশ্য দেখে গেছেন আখতার মুকুল। এত বড় দুঃখ ও অসীম যন্ত্রণায় ক্ষোভে নিজের মধ্যে অবিরাম যুদ্ধ করেছেন মৃত্যু শয্যায় পর্যন্ত। তখন চোখে ছিল সেই অশ্রু। এই অশ্রুর মূল্য দিতে আবারও কি এক মুক্তিযুদ্ধের জন্য বাঙালি জাগবে? মুক্তিযোদ্ধা চরমপত্রের স্রষ্টা মুকুল কবরে থাকলেও তাঁর আত্মা জেগে আছে, সঙ্গে আমরাও সেই যুদ্ধের অপেক্ষায় আছি। আবারও কি চরমপত্রের দিন শুরু হবে? আবারও কি পদ্মা-মেঘনা-যমুনার বুকে বয়ে যাবে রক্তমুখী শব্দে স্রোতধারা? আবারও কি ছড়াকার গাইবে- 'দেখেছিলি বিজয় তুই, তোর জন্য গোলাপ জুঁই, কোথায় গেলি-অনেক দূর? আবার ডাকে একাত্তর।'
আশার কথা হলো, আবার বৃক্ষ হবে, তাতে মুকুল ধরবে। আবার বাংলা জেগে উঠবে।
আবার কোনো যোদ্ধা মুকুল চরমপত্রের ভাষায় তীব্র কণ্ঠে বাংলার জয়গান গাইবে। 'চরমপত্রের মুকুল' যাবে কোথায়, এই বাংলাতে 'মুকুলের চরমপত্র' বেঁচে থাকবে।
আজ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মরণ করি তাঁকে।

No comments

Powered by Blogger.