যানজট বাড়াবে উড়ালসড়ক! by আনোয়ার হোসেন

রাজধানীর যানজট নিরসনে সরকার এখন ভরসা করছে উড়ালসড়ক ও সেতুর ওপর। এ জন্য প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এই অর্থে তিনটি উড়ালসেতু এখন নির্মাণাধীন এবং আরও চারটির নির্মাণকাজ শুরুর অপেক্ষায় রয়েছে।


যানজট কমাতে বিপুল অঙ্কের অর্থে এসব প্রকল্প নেওয়া হলেও ঢাকা মহানগর পুলিশ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উড়ালসড়ক রাজধানীর যানজট বরং আরও বাড়াবে। ঢাকার জন্য উড়ালসড়কের চেয়ে বাসের বিশেষ লেন ও মেট্রোরেলের মতো গণপরিবহন বেশি দরকার। তবে সরকার মেট্রোরেল ও বাসের বিশেষ লেন করার প্রকল্প নিলেও সেগুলো এখনো বাস্তবতার মুখ দেখেনি। তাই যানজট নিরসনে উড়ালসড়ক প্রকল্পই সরকারের ভরসা।
যানজট নিরসনে সরকার এখন মূলত যানজটবান্ধব এসব উচ্চাভিলাষী প্রকল্পের পেছনেই ছুটছে। সব প্রকল্পই বর্তমান সরকারের আমলে অনুমোদন পেয়ে কাজ শুরু হয়েছে।
উড়ালসড়ক প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত সরকারের বিভিন্ন বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, দুই কারণে উড়ালসড়ক প্রকল্পের প্রতি সরকারের ঝোঁক বেশি। প্রথমত, এটি সাধারণ জনগণকে দেখানো যায়। দ্বিতীয়ত, এসব প্রকল্পে যথেচ্ছ অর্থ ব্যয়ের আড়ালে একধরনের কমিশন-বাণিজ্যের মাধ্যমে পকেট ভারী করার সুযোগ থাকে। মহাখালী ও খিলগাঁও উড়ালসড়কের নির্মাণকাজে অর্থের অপচয় ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। মহাখালী উড়ালসড়কে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিল প্রকল্পের অর্থায়নকারী সংস্থা বিশ্বব্যাংক। তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ারও পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। ঢাকা মহানগর পুলিশ যানজট নিরসন ও যান চলাচলে শৃঙ্খলা বজায় রাখার ক্ষেত্রে সাতটি বড় চ্যালেঞ্জ নির্ধারণ করেছে। এগুলো হচ্ছে: মানুষের ঢাকামুখী স্রোত, যানবাহনের অধিক সংখ্যা, রাজনৈতিক কর্মসূচি, হাতিরঝিল প্রকল্প, যাত্রাবাড়ী উড়ালসড়ক, কুড়িল উড়ালসেতু ও কাকলী ক্রসিং। এই চ্যালেঞ্জগুলোর কথা ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে আনুষ্ঠানিকভাবে অবহিত করা হয়েছে।
১ জুন সড়ক ভবনে ঢাকার যানজট নিরসনসংক্রান্ত এক বৈঠকে ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে একটি পাওয়ার পয়েন্টের মাধ্যমে বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়। এ সময় যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক) মাহবুবুর রহমান বলেন, উড়ালসড়ক ঢাকার যানজট আরও বাড়াবে। উড়ালসড়কের কারণে যানজট বৃদ্ধি পাওয়ায় দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে সেগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে। পরে মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, উড়ালসড়কে গণপরিবহনের কোনো উন্নতি হবে না। এগুলো ঢাকায় যানবাহন বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে এবং যানজট ডেকে আনবে।
সরেজমিন: দেখা গেছে, জিয়া কলোনি, কুড়িল ও ঢাকা উড়ালসড়ক তিনটির শুরু বনানী থেকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, অর্থাৎ প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকার মধ্যে। কুড়িল উড়ালসড়কের সঙ্গে সংযোগ করা হয়েছে পূর্বাচলের সড়ক। পূর্বাচলের এই সড়কের সঙ্গে ছোট-বড় ১৯টি আবাসন কোম্পানির প্রকল্পের সংযোগ দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই তিনটি উড়ালসড়কে একাধিক ওঠানামার ব্যবস্থার (লুপ) কারণে কাকলী থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত যানজট বৃদ্ধি পাবে। পূর্বাচলের সংযোগ সড়ক চালু হলে যানজট ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
ঢাকা উড়ালসড়ক প্রকল্পটি ফার্মগেটে এসে প্রস্তাবিত মেট্রোরেল প্রকল্পের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে জানা গেছে। সে জন্য ফার্মগেট থেকে মানিক মিয়া এভিনিউর দিকে উড়ালসড়কে ওঠানামার যে ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল, তা বাতিলের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
ঢাকা উড়ালসড়কটি যাত্রাবাড়ী উড়ালসড়কের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। তাই সায়েদাবাদে দুটি উড়ালসড়কের মধ্যে সমন্বয় করার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া মগবাজারে প্রস্তাবিত উড়ালসড়কের ওপর দিয়ে নিতে হবে ঢাকা উড়ালসড়ক।
যানজট বাড়াবে: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক সারোয়ার জাহান প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকায় জনসংখ্যার ঘনত্ব অত্যন্ত বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকায় মানুষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত (ট্রিপ) স্বল্প দূরত্বেই বেশি করে। উড়ালসড়ক হচ্ছে বেশি দূরত্বের যাত্রার জন্য এবং এটি ব্যক্তিগত গাড়িবান্ধব। এর ওপর দিয়ে গণপরিবহন চলবে না। ফলে এসব স্থাপনা ব্যক্তিগত গাড়ি আরও বাড়াবে। যানজটও কমবে না।
সারোয়ার জাহানের মতে, ঢাকার জন্য উড়ালসড়কের চেয়ে বাসের বিশেষ লেন তৈরি ও মেট্রোরেলের মতো গণপরিবহন বেশি দরকার। ঢাকার জন্য প্রণীত ২০ বছরের পরিবহন পরিকল্পনায় (এসটিপি) উড়ালসড়ক পরে করে আগে বাসের বিশেষ লেন ও মেট্রোরেল করার কথা বলা হয়েছিল। সরকার সেটা মানেনি।
যত প্রকল্প: বর্তমানে ঢাকায় যেসব উড়ালসড়ক ও উড়ালসেতু প্রকল্পের কাজ চলছে সেগুলো হচ্ছে: কুড়িল উড়ালসেতু, জিয়া কলোনি উড়ালসড়ক ও মেয়র হানিফ গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী উড়ালসড়ক। এই তিনটি সড়ক নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে প্রায় দুই হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। কুড়িল উড়ালসেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), জিয়া কলোনি উড়ালসেতু সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর এবং যাত্রাবাড়ী উড়ালসড়ক ঢাকা সিটি করপোরেশন।
অন্যদিকে বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ঢাকা উড়ালসড়ক প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ সেতু বিভাগ। সরকারি-বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগে (পিপিপি) প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ইতালিয়ান-থাই করপোরেশনের সঙ্গে গত বছরের জানুয়ারি মাসে চুক্তি হয়েছে। এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা। তবে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান অর্থ জোগাড় করতে না পারায় এবং সরকার জমি অধিগ্রহণে দেরি করার কারণে প্রকল্পের কাজ এখনো শুরু হয়নি।
এর বাইরে মগবাজার-মৌচাক উড়ালসড়ক প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রকল্প করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। সৌদি আরব সরকার এই প্রকল্পে অর্থায়ন করতেও সম্মত হয়েছে। এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৭০ কোটি টাকা। বিজয়নগর-গোলাপ শাহ মাজার-বুড়িগঙ্গা সেতু পর্যন্ত আরেকটি উড়ালসড়ক করার প্রকল্প হাতে নিয়েছে রাজউক এবং ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
সেতু বিভাগ প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকায় ঢাকা-আশুলিয়া উড়ালসড়ক প্রকল্প হাতে নিয়েছে। পিপিপির ভিত্তিতে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে দরপত্রও আহ্বান করা হয়েছে।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, ডিসিসি ও রাজউক সূত্র জানিয়েছে, সরকার চমক হিসেবে আগামী ১৪ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে কুড়িল ও বনানী উড়ালসেতু এবং হাতিরঝিল প্রকল্পের একাংশ উদ্বোধন করবে। আর আগামী মার্চে উদ্বোধন করার কথা যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান উড়ালসড়ক।
জানতে চাইলে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, বিচ্ছিন্নভাবে উড়ালসড়ক প্রকল্প নিয়ে সুফল পাওয়া যাবে না। গণপরিবহনের কথা চিন্তা করে পুরো ঢাকাকে বিবেচনায় নিয়ে প্রকল্প নিতে হবে।
সমন্বয় নেই: ঢাকার যানজট নিরসন, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও পরিবহন ব্যবস্থাপনায় বর্তমানে অন্তত ১১টি সরকারি প্রতিষ্ঠান জড়িত। আরও পাঁচ-ছয়টি মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠান যানজটের কারণ বা প্রতিকারে নিয়োজিত। একেকটি দপ্তর পৃথক উড়ালসড়কসহ নানা প্রকল্প নিয়ে বাস্তবায়ন করছে। এই দপ্তরগুলোর কাজ সমন্বয় করার জন্য ঢাকা যানবাহন সমন্বয় বোর্ড (ডিটিসিবি) গঠন করা হলেও প্রতিষ্ঠানটি কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। আবার প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়ও নগরবাসী একদফা দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.