স্মরণ-উদ্যোগী উদ্যমী এক মানুষ by মো. শফিকুল ইসলাম

অধ্যাপক এম এ মতিন সম্পর্কে বাইরে থেকে একধরনের নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। কিন্তু একজন উদ্যোগী, উদ্যমী মানুষ হিসেবে তিনি যে পর্যায়ে বিচরণ করেছেন, সেই পর্যায়ে আমাদের পেশায়, এমনকি অন্যান্য পেশার খুবই কমসংখ্যক ব্যক্তিত্ব রয়েছেন।


এই বিবেচনায় তিনি বিরল ব্যক্তিত্বের অধিকারী। এ দেশের চিকিৎসাব্যবস্থায়, বিশেষ করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা খাতে তাঁর অবদান অতুলনীয়।
অধ্যাপক এম এ মতিন জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদের মন্ত্রিসভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর উদ্যোগে স্পেশালাইজড হাসপাতালগুলো পূর্ণাঙ্গরূপে কার্যক্রম শুরু করে। বিশেষ করে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, জাতীয় হূদরোগ ইনস্টিটিউট অধ্যাপক এম এ মতিনের বিশেষ উদ্যোগে যাত্রা শুরু করে। তিনি এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উদ্যোগে যোগাযোগ করে বিদেশে অবস্থানরত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়ে আসেন। আইপিজিএমআরেও বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক যোগদান করেন।
অধ্যাপক এম এ মতিনের উদ্যোগে বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস ধানমন্ডির ভাড়া করা বাড়ি থেকে মহাখালীর নিজস্ব ভবনে স্থানান্তরিত হয়। তিনি উদ্যোগ নিয়ে মহাখালীর জমির সংস্কারের ব্যবস্থা গ্রহণ করে বিসিপিএস ভবনের নির্মাণকাজ ত্বরান্বিত করেন। তিনি ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া, নর্থ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজসহ ২০ জেলায় বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছেন।
অধ্যাপক এম এ মতিন কয়েকবার বাংলাদেশ চক্ষু চিকিৎসক সমিতির (ওএসবি) সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি সমিতির বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। মিরপুরে ওএসবি ভবন তাঁরই উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত।
অধ্যাপক এম এ মতিন সাহেবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুযোগ হয়েছে আমার। অনেক বিষয়ে মতবিরোধ হয়েছে। তাঁর পরও দেখেছি, আপন ঔদার্যে তিনি কাছে টেনে নিয়েছেন। পিতৃস্নেহের মতোই তিনি স্নেহের বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন।
বাংলাদেশ চক্ষু চিকিৎসক সমিতির প্রথম কোর্স ও কারিকুলাম কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন অধ্যাপক এম এ মতিন এবং সদস্যসচিব আমি। ওই কমিটির কাজ করতে গিয়ে কর্মপাগল এই মানুষটির সঙ্গে আমার ভিন্ন মাত্রিকের পরিচয় ঘটে। তাঁর সময়ই কোর্স কারিকুলাম কমিটি ওএসবি সদস্যদের সামনে আশার আলো দেখাতে সক্ষম হয়। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনসের (বিসিপিএস) নির্বাহী কমিটিতে পরিবর্তন আসে। নতুন কমিটি বিভিন্ন বিষয়ের ফ্যাকাল্টিসমূহ পুনর্গঠন করে। ফ্যাকাল্টি অব অফথালমোলজির চেয়ারম্যান হিসেবে মনোনীত হন অধ্যাপক মতিন। আমি সদস্যসচিবের দায়িত্ব পাই। বিসিপিএসের উন্নয়ন-প্রক্রিয়ার সঙ্গে নেতৃত্বে ছিলেন যে মানুষটি, বিসিপিএসের একসময় সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন যে মানুষটি, তিনি সেই প্রতিষ্ঠানের একটি বিষয়ের ফ্যাকাল্টির সভাপতির দায়িত্ব পালন করতে এতটুকু ইতস্তত করেননি। তিনি ফ্যাকাল্টির বিকাশের জন্য যে গভীরভাবে চিন্তা করতেন, তা বুঝতাম যেকোনো মুহূর্তে ফোন পাওয়ায়। যখনই যে বিষয় তাঁর মনে পড়ত, ফোনে সে লক্ষ্যে দিকনির্দেশনা দিতেন। ফ্যাকাল্টির সভাগুলোতে তিনি যথাসময়ে উপস্থিত হতেন।
৩০ মে অধ্যাপক এম এ মতিন সাহেবের সঙ্গে শেষ দেখা হয়। বাংলাদেশ একাডেমি অব অফথালমোলজির সভা ছিল জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে। সভা শেষে তাঁকে নিয়ে সভাস্থল ত্যাগ করি।
অধ্যাপক মতিন আমাকে বললেন, ‘আমার গাড়িতে ওঠো।’
আমি তাঁর কথা ফেলতে পারিনি। আমি বললাম, ‘ঠিক আছে স্যার, আমাকে আসাদগেটে নামিয়ে দিলেই হবে।’
আমাদের দেখে তাঁর গাড়ি আসে। তিনি আমাকে বলেন, ‘শফিক, তুমি সামনের দরজা দিয়ে ওঠো। কিছু মনে করো না। সামনের সিটে বসো। পেছনের সিটে আমার বিছানা, বালিশ।’
গাড়িতে ওঠার পর আবার বললেন, ‘দেখলে তো, কাঁথা-বালিশ! ইদানীং আমি পেছনের সিটটায় ঘুমিয়ে পড়ি। বিশেষ করে রাস্তায় জ্যাম ইত্যাদি মিলিয়ে বিলম্বে বসে থাকতে পারি না।’
আমি দেখলাম, পেছনের সিটে বালিশ-কাঁথা। এক ধরনের মায়াবোধ হয় স্যারের জন্য। মনে হলো মানুষটা ক্লান্ত। এককালের ব্যস্ত জাঁদরেল মন্ত্রী এখন বিশ্রামের কোলে আশ্রয়প্রার্থী।
আমরা কথা বলি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে বড় পরিসরে গড়ে উঠবে—এসব নিয়ে। আমি বলি, বিশ্ববিদ্যালয়ের আউটার ক্যাম্পাস হিসেবে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটকে (এনআইও) নেওয়া উচিত। তিনি আমাকে সমর্থন করেন; বলেন, ‘কেবল এনআইও নয়, নিটোর (পঙ্গু হাসপাতাল) এনআইসিভিডিও (জাতীয় হূদরোগ ইনস্টিটিউট) হতে পারে ক্যাম্পাসের অংশ। এ ধরনের পদক্ষেপে বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা বাড়বে। তেমন কঠিন কাজও না। সরকারের নির্বাহী আদেশেই তা করা সম্ভব।’ আমি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি দেখে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত করি। এ জন্য করি যে, তিনি মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধপক্ষের একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান। তার পরও দেশের একাডেমিক স্বার্থের দিকে তাঁর গভীর অভিনিবেশ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। আমার মনে পড়ে, সামান্যক্ষণ আগে সভা শেষে নেপালের কথা বলছিলাম। নেপালে ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন ফ্যাকাল্টির ডিন আমাদের দেশে পড়াশোনা করেছেন। নেপালের বেশ কটি ইনস্টিটিউটের নির্বাহী প্রধান হিসেবে কাজ করছেন বাংলাদেশ থেকে পড়াশোনা করা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। এসব বিজ্ঞজনের ছাত্রকালীন সময় কেটেছে যখন অধ্যাপক মতিন এ দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
স্যারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আসাদগেটে পৌঁছাই। আমি চালককে বললাম রাস্তার পাশে দাঁড়াতে। আমি দরজা খুলি। স্যার বললেন, ‘শফিক, মনে কিছু করো না, তোমাকে বাসায় নামাতে পারলে ভালো হতো।’
ও-ই শেষ সংলাপ আমার সঙ্গে। আর কোনো দিন দেখা হবে না। আর কোনো দিন এভাবে গাড়িতে উঠব না। ১৩ জুন সকালবেলায় শান্তিনগরের বাড়িটায় শোকের স্রোতে ভেসে যাওয়া মানুষের ঢলে স্যারের চেম্বারে গিয়েছিলাম। স্যারের ফ্যাক্স মেশিন, কম্পিউটার—সবই রয়েছে পাশে। তিনি ঘুমিয়ে আছেন। হাসিমুখে প্রশান্তির ঘুম।
মো. শফিকুল ইসলাম
অধ্যাপক, চক্ষুবিজ্ঞান বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.