আম-বাণিজ্যের জন্য ছাত্রলীগকে ফুটপাত বরাদ্দ দিল ডিসিসি by শরিফুল হাসান

মানুষের হাঁটাচলার জন্য ফুটপাত। অথচ রাজধানীর কিছু এলাকার ফুটপাত আমের দোকানের জন্য বরাদ্দ দিয়েছে ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) দক্ষিণ। এসব বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের নেতাদের নামে। তবে দোকান চালাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।


সরেজমিনে দেখা যায়, মতিঝিল, নিউমার্কেট, ধানমন্ডি, কলাবাগান, হাজারীবাগসহ বিভিন্ন এলাকার ফুটপাতে দোকানের পর দোকান সাজিয়ে চলছে আমের মেলা। কোনোটির বরাদ্দ আছে আবার কোনোটির নেই। গত মাস থেকে এসব মেলা শুরু হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিটি করপোরেশনের একশ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহায়তায় থানা ছাত্রলীগের নেতারা এসব ফুটপাত বরাদ্দ নিয়েছেন। প্রতি বর্গফুট ফুটপাত বরাদ্দ পেতে তাঁরা সিটি করপোরেশনকে দিয়েছেন পাঁচ টাকা করে। কিন্তু তাঁরা একেকটি দোকান বরাদ্দ দিতে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়েছেন ৫০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত।
ছাত্রলীগের নেতাদের নামে ফুটপাত বরাদ্দ দেওয়াসংক্রান্ত সিটি করপোরেশনের একাধিক চিঠি প্রথম আলোর কাছে আছে। যেমন, ৪৬,২০৭,০০০, ১৩,০১ ১৭২৩ ২০১২ স্মারক নম্বরের চিঠিতে সিটি করপোরেশন ধানমন্ডির সীমান্ত স্কয়ারের বিপরীতে লেকসংলগ্ন ফুটপাতে মেলা করার অনুমতি দিয়েছে হাজারীবাগ থানা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রতি বর্গফুট পাঁচ টাকা হারে ৩২০ বর্গফুট জায়গা এক হাজার ৬০০ টাকায় ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হলো। মোট আটটি শর্তে এক মাসের জন্য এই বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২ ও ৩ নম্বর শর্তে বলা হয়েছে, জন ও যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটানো যাবে না। অথচ ফুটপাত বরাদ্দ দিলে সেখানে চলাচল সম্ভব নয়। এ ছাড়া প্রথম শর্তে বলা হয়েছে, বর্ণিত জায়গার মালিকানা দাবি করা যাবে না। এ বিষয়ে কোনো মামলা করা যাবে না। বরাদ্দের এ চিঠিতে সই করেছেন সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা।
জানতে চাইলে হাজারীবাগ থানা ছাত্রলীগের সভাপতি আরজু মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মৌসুমি আমের মেলা করতে সিটি করপোরেশনে আবেদন করেছিলাম। ডিসিসি অনুমতি দিয়েছে। আমাদের ছেলেরাই দোকান চালাচ্ছে। আমরা বৈধভাবেই সব করছি।’
নিউমার্কেট ক্রসিং চত্বরে ফুটপাতে আমের মেলা করার অনুমতি পেয়েছেন নিউমার্কেট থানা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। অভিযোগ উঠেছে, এখানে ব্যবসায়ীদের দোকান বরাদ্দ দিতে পাঁচ লাখ টাকা নিয়েছেন ছাত্রলীগের নেতারা।
এ বিষয়ে নিউমার্কেট থানা ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম সোহেল রানা বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই আমরা এই আমের মেলা করছি। ছাত্রলীগের ছেলেরাই এখানে দোকান চালাচ্ছে। তবে একটি দোকান আমরা ইস্পাহানি গ্রুপকে দিয়েছি।’ বরাদ্দের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি ও আমার সাধারণ সম্পাদকের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।’
এলিফ্যান্ট রোডে বাটা মোড়ে সড়কদ্বীপে আমের মেলা করার অনুমতি পেয়েছেন নিউমার্কেট থানা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মিজান ও সাধারণ সম্পাদক ফরিদ। মিজান বর্তমানে যুবলীগের ও ফরিদ স্বেচ্ছাসেবক লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
আমের মেলার জন্য ফুটপাত বরাদ্দ দেওয়ায় ভয়াবহ অবস্থা হয়েছে পান্থপথ এলাকায়। এখানে বসুন্ধরা সিটির উল্টো দিকের ফুটপাতজুড়ে আমের মেলা চলছে। ফলে এ এলাকায় মানুষের হেঁটে চলা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। এখানকার ফুটপাতের বরাদ্দ পেয়েছেন ধানমন্ডি থানা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নাজিমউদ্দিন।
এখানকার একটি আমের দোকানি রুহুল আমিন নিজেকে ব্যবসায়ী দাবি করেন। দোকান বরাদ্দ নেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি এসব নিয়ে কথা বলতে পারব না। যুবলীগের পারভেজ ভাই আমাকে সব করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, কেউ এলে যেন তাঁর নাম বলি।’ কোত্থেকে আম আনেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে।
আরেক দোকানি মোহাম্মদ রাসেল জানান, ছাত্রলীগের নেতা নাজিমউদ্দিনের অনুমতি নিয়ে তিনি দোকান দিয়েছেন। রমজান মাস পর্যন্ত তিনি দোকান চালাবেন।
জানতে চাইলে নাজিমউদ্দিন বলেন, ‘ডিসিসি থেকে অনুমতি এনে ছাত্রলীগের ছেলেরা দোকান করছে। এখানে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নেই।’
পান্থপথে ‘আমের মেলা’ নামের একটি দোকানের মোহাম্মদ ইয়াকুব জানান, তাঁরা পাঁচজন মিলে ৭০ বর্গফুটের এই দোকান নিয়েছেন। কানসাট ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আম আনেন। কার কাছ থেকে বরাদ্দ নিয়েছেন, জানতে চাইলে বলেন, ‘দোকানের অনুমতি দিয়েছেন ফারুক ভাই। কিছু হলে তাঁরা দেখবেন বলেছেন।’
এই ফারুক হলেন কলাবাগান থানা ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদি হাসান ওরফে ফারুক। তিনি বলেন, ‘এলাকার ফল ব্যবসায়ী আক্কাস ও ইয়াকুব আমাদের অনুমতি এনে দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। তাঁদের অনুরোধেই আমরা সিটি করপোরেশন থেকে অনুমতি এনে দিয়েছি।’ বিনিময়ে কী পেয়েছেন, জানতে চাইলে বলেন, ‘না, আমরা কিছু নিইনি।’
পান্থপথের ফুটপাতজুড়ে এত আমের দোকানের বিষয়ে জানতে চাইলে কলাবাগান থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘থানা ছাত্রলীগের সভাপতি ফারুক ও আমার নামে এখানে চারটি দোকান বরাদ্দ দিয়েছে সিটি করপোরেশন। অন্য দোকানগুলো সম্পর্কে আমরা জানি না। এলাকার ছেলেরা এই দোকানগুলো করেছে। সেখান থেকে আমরা এক টাকাও নিইনি। একটা আমও ধরে দেখিনি।’ আপনাদের বরাদ্দ পাওয়া দোকানগুলো কারা চালাচ্ছে, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা তো ব্যবসা জানি না। আমরা অনুমতি এনে দিয়েছি। ছাত্রলীগের ছেলেদের সঙ্গে ব্যবসায়ীরা মিলে ব্যবসা করছেন।’
ধানমন্ডি মাঠের পাশে আমের মেলা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। এখানে দোকান চালাচ্ছেন ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন। তাঁকে যেন কেউ বিরক্ত না করে তা দেখছে থানা ছাত্রলীগ। এ বিষয়ে ধানমন্ডি থানা ছাত্রলীগের সভাপতি সুজাউদ্দিন তুহিন বলেন, ‘আমরা নিজেদের নামে অনুমতি নিইনি। ইসমাইল ভাই এলাকার মানুষ। তিনি ব্যবসা করতে চেয়েছেন। আমাদের অনুরোধ করেছেন এলাকার কেউ যেন বিরক্ত না করে। আমরা সেটিই করছি।’
সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, আমের মেলার জন্য ছাত্রলীগের নেতাদের ফুটপাত বরাদ্দের বিষয়ে যোগসাজশ রয়েছে সিটি করপোরেশনের জরিপকারী মিজানুর রহমানের। তবে বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমি কেবল সরেজমিনে সুপারিশ করে আমার মতামত দিয়েছি। ডিসিসির প্রশাসক থেকে শুরু করে সবাই বিষয়টি জানেন। তাঁদের অনুমতি ছাড়া কিছু হয় না।’
জানতে চাইলে সিটি করপোরেশন দক্ষিণের সম্পত্তি কর্মকর্তা বেলাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেলার নামে ফুটপাত বরাদ্দ দেওয়া আসলেই সমীচীন নয়।’ তাহলে কেন দিলেন জানতে চাইলে বলেন, ‘জনগণের চাপ থাকলে, চাহিদা থাকলে দিতে হয়।’ জনগণ কারা? তিনি বলেন, ‘আমরা তো মাত্র চারটি জায়গায় অনুমতি দিয়েছি। কিন্তু মেলা চলছে অনেক জায়গায়। সেসব জায়গায় কীভাবে চলছে আমরা জানি না।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তার মতে, এমনিতে ভয়াবহ যানজট। ফুটপাত বরাদ্দ দেওয়ায় যানজট আরও বেড়েছে।
কতটা রাসায়নিকমুক্ত: ফুটপাতের এসব আমের মেলার দোকানিদের দাবি, তাঁদের আম শতভাগ রাসায়নিকমুক্ত এবং সরাসরি রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আনা। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। বাংলাদেশ মান নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠানের (বিএসটিআই) ভ্রাম্যমাণ আদালত বৃহস্পতিবার অভিযান চালিয়ে এমন কিছু দোকানকে জরিমানা করেছেন।
ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট রাসেলুল কাদের প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে ধানমন্ডি ও রামপুরা এলাকায় ফুটপাতে বসা এমন মেলায় অভিযান চালিয়েছি। কোনোটিতেই আমরা রাসায়নিকমুক্ত আম পাইনি। বরং যেখানে রাসায়নিকমুক্ত বলা হয় সেখানে সমস্যা থাকে আরও বেশি।’
আরেকজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবু সাঈদ জানান, শিগগিরই তাঁরা আবার অভিযান শুরু করবেন।

No comments

Powered by Blogger.