সাবধানে খাবার খান, ক্যান্সার দূরে রাখুন by আবু এন এম ওয়াহিদ

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতিবছর পৃথিবীতে যে পরিমাণ মানুষ মারা যায়, তার প্রায় ১৩ শতাংশের মৃত্যু হয় ক্যান্সারের কারণে। অনেকে মনে করেন, ক্যান্সার একটি হেরিডিটারি রোগ, যা বংশানুক্রমে এক পুরুষ থেকে আরেক পুরুষে ছড়িয়ে যায়। যেসব ক্যান্সার রোগীর বংশে এই কঠিন রোগের কোনো ইতিহাস নেই, তাঁরা মনে করেন, ভাগ্যই এ জন্য দায়ী।


মুসলমান হিসেবে আমরা যাকে ভাগ্য বলি, বিজ্ঞানের ভাষায় তাকে বলা হয় 'র‌্যান্ডম ফ্যাক্টর'। ভাগ্য বা 'র‌্যান্ডম ফ্যাক্টর' যা-ই বলি, এ কারণে ক্যান্সার হলে কারো কিছু করার নেই। তবে 'কজ অ্যান্ড ইফেক্ট' কিংবা কার্যকারণের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, জীবনযাত্রা এবং খাদ্যাভ্যাসের জন্যও অনেক সময় মানুষ কর্কট রোগে আক্রান্ত হতে পারে। আর এখানে সাবধানতা অবলম্বন করে আমরা অনেক সময় ক্যান্সারকে আমাদের জীবন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারি। নিজে বাঁচতে পারি, প্রিয়জনকে বাঁচতে সাহায্য করতে পারি। ডাক্তারি পরিসংখ্যান থেকে আরো জানা যায়, বিশ্বব্যাপী এক-তৃতীয়াংশ ক্যান্সারের কারণ খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে সংযুক্ত। আরো দেখা যায়, শুধু ধূমপান ছেড়ে দিলেই ক্যান্সারের ঝুঁকি ৩০ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব। যাদের পরিবারে ক্যান্সারের কোনো ইতিহাস নেই, তাদের ঝুঁকি আরো ১৫ শতাংশ কম। এ ছাড়া স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খেলে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আরো ৩০ শতাংশ কমে যায়। ক্যান্সার-সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য গবেষণায় দেখা যায়, যারা তাজা ফলমূল, শাকসবজি ও তরিতরকারি খুব কম খায় অথবা একেবারেই খায় না, তাদের ক্যান্সার-ঝুঁকি ফল-তরকারি খাওয়া লোকদের চেয়ে দ্বিগুণ বেশি।
ক্যান্সার মানুষের দেহের সেল বা জীবকোষের একটি রোগ। একজন সুস্থ মানুষের শরীরে থাকে ৬০ থেকে ৯০ লাখ কোটি সেল। এর যেকোনো একটি বা একাধিক সেলকে কেন্দ্র করে ক্যান্সারাস টিউমার দানা বাঁধতে পারে। তবে এটা হঠাৎ করে হয় না। এই প্রক্রিয়ায় সময় লাগে অনেক। এই দীর্ঘসূত্রতা আমাদের জন্য একটি সুখবরও বটে। কারণ আমরা যদি সঠিক কৌশলে এগোতে পারি, তাহলে বিদ্রোহী সেলের ক্যান্সারাক্রান্ত হওয়ার প্রক্রিয়াকে শ্লথ করে দিতে পারি; এমনকি বন্ধও করে দিতে পারি। অন্যথায় আমরা গাফেল হয়ে থাকলে ধীরে ধীরে ক্যান্সার সেলটি শক্তি সঞ্চয় করে আমাদের অতি সহজেই মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে।
যেসব ক্যান্সার সেল স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাদের শরীরে জন্ম নেয়, তারা শুরুতে এতটাই ক্ষুদ্র থাকে যে মাইক্রোস্কোপ ছাড়া খালি চোখে দেখা যায় না এবং দেখা যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ওই অবস্থায় আমাদের শরীরে কোনো অসুবিধাও হয় না, তাই আমরা নিজ দেহে ক্যান্সার সেলের উপস্থিতি বুঝতে পারি না। এ ধরনের ক্যান্সার সেল দেহে আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে। ফলমূলে যেসব অ্যান্টিয়েনজিওজেনেসিস মলিকুল থাকে, সুযোগ পেলে তারা উৎসমুখে ক্যান্সার সেলকে আক্রমণ করে এবং সেগুলোকে বাড়তে দেয় না। তাই দেখা যায়, ক্যান্সার আসলে একটি ক্রনিক রোগ; এবং দৈনিক ভিত্তিতে ঠিকমতো খ্যাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে পারলে আমরা এই মারাত্মক মারণব্যাধিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, এমনকি ধ্বংসও করে দিতে পারি। ফলমূলের যেসব উপাদান ক্যান্সারবিনাশী, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ফাইটোকেমিক্যালস নামের একধরনের রাসায়নিক উপাদান। যেসব ফলমূল, শাকসবজি, তরিতরকারি ও মসলার মধ্যে এই উপাদান পাওয়া যায়, সেগুলো হচ্ছে- রসালো ফলের মধ্যে ব্লুবেরি, স্ট্রবেরি, আঙুর এবং তরকারির মধ্যে সয়াবিন, টমেটো, বাঁধাকপি, ব্রোকলি, ফুলকপি, ব্রাসেলস স্প্রাউট (বাঁধাকপির মতো জলপাই আকারের এক জাতের ছোট্ট তরকারি)। ক্যান্সার সেলের বিরুদ্ধে এসবই ধন্বন্তরির মতো কাজ করে। এ ছাড়া লেবু এবং গ্রিন টিতে আছে প্রচুর পরিমাণ ফাইটোকেমিক্যালস। ফাইটোকেমিক্যালস মানবদেহে ক্যান্সার প্রবৃদ্ধি প্রক্রিয়াকে সহজেই বাধাগ্রস্ত করে দিতে পারে। তাজা সবজির মধ্যে ক্যান্সার রোগে ব্রোকলি সবচেয়ে ভালো ও কার্যকর। তরকারি হালকা সিদ্ধ কিংবা স্টার ফ্রাই করলে অ্যান্টি-ক্যান্সার মলিকুলের কার্যকারিতা বেশি থাকে। মসলার মধ্যে হলুদ, পেঁয়াজ ও রসুন কর্কট রোগে খুবই উপকারী। চার হাজার বছর ধরে মানুষ এসব মসলা ব্যবহার করে আসছে। রান্নার চেয়ে তাজা পেঁয়াজ-রসুন ক্রাশ করে (ছেঁচে) খেলে উপকার বেশি পাওয়া যায়। নিয়মিত সয়াবিন তেল, সয়া দুধ, সয়া সস, টফু ইত্যাদি খেলেও ক্যান্সার সেলের প্রবৃদ্ধির গতি রোধ করা সম্ভব। স্তন ও প্রোস্টেট ক্যান্সারের জন্য সয়া-জাতীয় খাবার খুবই উপকারী। গবেষণায় দেখা গেছে, মেয়েরা অল্প বয়স থেকে সয়া প্রডাক্ট খেয়ে থাকলে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যায়।
গ্রিন টি আরেকটি অতি উপকারী ক্যান্সার প্রতিষেধক পানীয়। তবে গ্রিন টির মধ্যে চায়নিজ গ্রিন টির চেয়ে জাপানি গ্রিন টি অনেক বেশি কার্যকর। গ্রিন টি খাওয়ার আগে একটি বিষয় ভালোভাবে জানা থাকা প্রয়োজন। খুব অল্পক্ষণ কিংবা বেশিক্ষণ আগুনে জ্বাল দিলে গ্রিন টি থেকে সর্বোত্তম উপকারিতা পাওয়া যায় না। গবেষণায় দেখা যায়, কর্কট রোগে ৮-১০ মিনিট জ্বাল দেওয়া গ্রিন টির কার্যকারিতা সবচেয়ে বেশি। বিভিন্ন ধরনের জামজাতীয় ফলও ক্যান্সারের জন্য বিশেষভাবে উপকারী। ব্লুবেরি, ক্র্যানবেরি, র‌্যাসবেরি ইত্যাদি সবই ভালো। তবে এদের প্রক্রিয়াজাত রসের চেয়ে তাজা বেরি অধিক উপকারী।
সাইট্রাস ফলের মধ্যে আছে কমলা, বাতাবিলেবু বা জাম্বুরা, সবুজ কাগজিলেবু ও হলুদ লেবু। এগুলোর সবই ক্যান্সার প্রতিষেধক। এগুলো শুধু ক্যান্সারবিনাশীই নয়, বরং প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন 'সি' এবং বিভিন্ন জাতের খনিজ পদার্থের মাধ্যমে শরীরের সাধারণ রোগ প্রতিষেধক ক্ষমতাও বাড়িয়ে দেয়। কোকো থেকে তৈরি হয় চকোলেট। এটাও ক্যান্সারের জন্য খুবই উপকারী। তবে দুধ চকোলেটের চেয়ে তিতা। কালো চকোলেট অনেক বেশি কার্যকর। মাছের মধ্যে সারডিন, স্যামন ও ম্যাকরেল কর্কট রোগের মহৌষধ। শুকনো ফলের মধ্যেও ক্যান্সার প্রতিরোধক অনেক গুণাগুণ রয়েছে। সাধারণ চিনাবাদাম থেকে শুরু করে কাজুবাদাম পর্যন্ত সব ধরনের বাদামই এই রোগে উপকারী। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উপকারী হলো আমন্ড, যা বাংলাদেশে কাঠবাদাম বা খুবানি নামে পরিচিত। এখানে যেসব খাবারের আলোচনা করলাম, তার মধ্যে টক-ঝাল-মিষ্টি সবই রয়েছে। কোনোটার স্বাদ একটু বেশি, কোনোটার কম। কোনোটা দামে সস্তা আবার কোনোটা অনেক দামি। সবই বাংলাদেশে হয়ও না, আবার অনেকটাই সহজেই অল্প মূল্যে দেশের সর্বত্রই পাওয়া যায়। আসুন, আমরা স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলি এবং ক্যান্সার থেকে দূরে থাকি।
লেখক : অধ্যাপক,
টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি, এডিটর : জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ। awahid2569@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.