নিরাপদ মাতৃত্ব ও মায়ের অধিকার by মুফতি এনায়েতুল্লাহ

নিরাপদ মাতৃত্ব প্রত্যেক নারীর স্বীকৃত এক অধিকার। এ অধিকার অর্জনে বাংলাদেশ এখনও বেশ পেছনে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে অসচেতনতা, গর্ভকালীন প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা না পাওয়া ও অদক্ষ দাইয়ের হাতে বাচ্চা প্রসব করানোর ফলে বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে।


এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রতি বছর ২৮ মে পালিত হয় 'আন্তর্জাতিক নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস'। নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো, মাতৃত্বকে নারীর অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।
এ দেশের অধিকাংশ মা অপুষ্টি ও রক্তশূন্যতায় ভোগেন, যা মাতৃমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। এর পেছনে রয়েছে প্রচলিত কিছু সামাজিক কুসংস্কার। যেমন, গ্রামে অনেক পরিবারে গর্ভকালীন হাঁসের গোশত, মুরগির ডিম, মৃগেল মাছ ও কচুশাকসহ অনেক পুষ্টিকর খাবার একদম খেতে দেওয়া হয় না। এমনকি গর্ভকালীন মায়েদের শারীরিক ও মানসিক পরিচর্যার ক্ষেত্রেও অবহেলা করা হয়। বরং অনেক সময় তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়, পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ দেওয়া হয় না। কর্মজীবী নারীদের সমস্যা আরও প্রকট। সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি থাকলেও বেসরকারি পর্যায়ে মায়েরা অনেক ক্ষেত্রেই এখনও ছুটি থেকে বঞ্চিত। অবশ্য কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে ছুটি দেওয়া হলেও বেতন মিলছে না। বিশেষ করে পোশাক শিল্পের নারী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এই আচরণ বেশি হচ্ছে; এ অবস্থার অবসান হওয়া দরকার।
আমরা জানি, মায়ের সুস্থতার ওপর নির্ভর করে সন্তানের নিরাপদ জন্ম ও সুস্থ জীবন। তাই মায়ের স্বাস্থ্য ও সুস্থতা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নিরাপদ স্বাস্থ্য মায়ের অধিকার। আর এ অধিকার আদায়ে সংশিল্গষ্ট সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যমসহ সমাজসচেতন সবাইকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। ইসলামও এ বিষয়ে বেশকিছু দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে।
প্রত্যেক মানবশিশুরই সুস্থ শরীর নিয়ে জন্মগ্রহণ করার অধিকার রয়েছে। এ কথা খুবই স্বাভাবিক যে, একজন পুষ্টিহীন মা কখনোই সুস্থ-সবল শিশুর গর্বিত মা হতে পারেন না। এ জন্য মায়ের পুষ্টির ব্যাপারে অতিরিক্ত যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। তা ছাড়া গর্ভস্থ ভ্রূণের সঠিক গঠন ও বৃদ্ধির জন্য মাকে সুষম ও বাড়তি খাবার দিতে হবে। ইসলাম এই দায়িত্ব সর্বতোভাবে পুরুষের ওপর ন্যস্ত করেছে। ইসলাম পরিবার-পরিজনের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করাকে সদকার সমতুল্য সওয়াবের কাজ বলে করেছে। এ প্রসঙ্গে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, 'কোনো মুসলিম ব্যক্তি সওয়াবের আশায় তার পরিবার-পরিজনের জন্য যা কিছু ব্যয় করে তা তার জন্য সদকা হিসেবে গণ্য হয়।' একজন মানুষের পৃথিবীতে আসার সূচনা থেকে শুরু করে পরিপূর্ণ মানুষে পরিণত হওয়ার আগ পর্যন্ত তার সুন্দর-সুস্থ জীবন নিশ্চিত করতে নিজের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলেন গর্ভধারিণী মা। সন্তানকে জন্মদান যেমন একজন নারীর পূর্ণতা এনে দেয়, তেমনি একজন মানুষকে সুযোগ করে দেয় এই সুন্দর ধরণীতে আসার জন্য। কিন্তু সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে আমরা মায়েদের কতটা নিরাপদে রাখতে পেরেছি সেটা ভাবার বিষয়। তার চেয়েও বড় কথা হলো জন্মদাত্রী মায়ের সঙ্গে আমাদের ব্যবহার। আমাদের সমাজের অনেকেই মায়ের সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে রূঢ় ও খারাপ আচরণ করে থাকেন। যা কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়। এটা ইসলামবিরোধী কাজ। মায়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহারকারী সন্তানের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তির ঘোষণা। হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) এ প্রসঙ্গে বলেন, 'তিন ধরনের লোকের ওপর আল্লাহতায়ালা বেহেশতকে হারাম করেছেন। ১. মদপানে অভ্যস্ত ব্যক্তি; ২. মা-বাবার অবাধ্য সন্তান; ৩. দাইয়ুস_ যে নিজ পরিবারের নির্লজ্জ ও বেহায়াপনাকে সমর্থন করে।'
কোনো সন্তানই মাতৃত্বের ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না; এটা সম্ভবও নয়। এক ব্যক্তি হজরত রাসূলুল্লাহকে (সা.) জিজ্ঞেস করল, 'ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আমার মাকে কোলে করে কাবা শরিফ তাওয়াফ করেছি, এতে কি আমি আমার মায়ের প্রতি কিছুটা অনুগ্রহ করিনি?' হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) না-সূচক উত্তর দিয়েছিলেন। মায়ের সন্তানবাৎসল্য ও তার কষ্টের জন্যই আল্লাহতায়ালা মায়ের মর্যাদা ও তার প্রতি দায়িত্ব অধিক করে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, 'আর আমি তো মানুষকে তার মা-বাবার প্রতি সদয় ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি। তার জননী তাকে গর্ভে ধারণ করে কষ্টের সঙ্গে এবং প্রসব করে কষ্টের সঙ্গে।' সুরা আহকাফ : ১৪
এখন প্রশ্ন হলো, সন্তান হিসেবে আমরা মায়ের প্রতি দায়িত্ব কতটুকু পালন করেছি তা আলোচনার দাবি রাখে। মায়ের প্রতি ভালোবাসা, মমতা ও দায়িত্বশীলতা প্রদর্শন দিনবিশেষের জন্য নয়, বরং প্রতিদিনের। মায়ের সেবা, আনুগত্য, অধিকার আদায় করা আমাদের প্রত্যেকের ওপর ফরজ আমলবিশেষ। আমাদের কোনো আচরণে মা যেন কষ্ট না পান, দুঃখ না পান, সেদিকে আমাদের সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে। এখন সেই মায়েরাই যদি পৃথিবীতে মানবধারার গতি রক্ষা করতে গিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তাহলে এর অবহেলার দায় কিন্তু আমাদের ওপর অবশ্যই বর্তাবে। সুতরাং আমাদের অত্যন্ত হিসাব করে পথ চলতে হবে।
নিরাপদ মাতৃত্ব ও মায়ের অধিকারের এই হতাশাজনক পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে হলে নারীদের মধ্যে ইসলামী শিক্ষার প্রসার বাড়াতে হবে। স্বল্পমূল্যে সহজে চিকিৎসাসেবা মানুষের দ্বারে পেঁৗছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমেই মায়ের মাতৃত্ব ও অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব।
muftianaet@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.