দূরের দূরবীনে-আশা ভোঁশলের সিডনি-সন্ধ্যা ও জয়তু বাংলাদেশ by অজয় দাশগুপ্ত

বিদেশে বসবাসের এক শ একটা খারাপ দিক আছে। কিন্তু একটি মাত্র ভালো দিকের বিবেচনায় সেই খারাপ বোধগুলো মুহূর্তে তুচ্ছ হয়ে উঠতে পারে। অদর্শনজনিত প্রেম ও তার তীব্র আবেগে দেশ, জাতীয়তা, ভাষা ও সংস্কৃতি কতটা আপন ও গৌরবের সেটা প্রবাসে বসবাস না করলে বোঝা অসম্ভব।


দূর থেকে দেখা স্বদেশ তার শরীরে চাপানো যাবতীয় গ্লানি, বোঝা, ক্লেদ আর ধ্বংস ছাড়িয়ে এতটা আনন্দের বা আশ্চর্য সুন্দরের হয়ে ওঠে ভাবতেই মন ভালো হয়ে যায়। দিনের পর দিন কর্মক্লান্ত, ডলারে, পাউন্ডে, দিনারে, রুবেলে স্ফীত বাঙালির ঘর্মাক্ত অবয়ব, একপেশে জীবনে ওঠানামাহীন মুখশ্রীতে আনন্দ কখন ভেসে ওঠে জানেন? যখন তার হাতের মুঠোয় ধরা একখানি কাগজ অথবা টিকিট, টুঁটি চিপে ধরা স্যুটকেস টানতে টানতে এয়ারপোর্টে ধাবমান বাঙালির মতো সুখী মানুষ দ্বিতীয়টি চোখে পড়ে না। এদের এই যাতায়াত দেখে আমি আনন্দে আপু্লত হয়ে পড়ি। এক বাঙালিকে জানি, প্রতিষ্ঠিত। অর্থ বিত্ত-বৈভবে চোখ ধাঁধানো সাফল্যের উজ্জ্বল উদাহরণ, যখন এ দেশে অসুখী, অসুখ বলতে গেলে মানসিক রোগী, দেশে যাওয়ার আগে আর ফিরে আসার পর কিছু দিন তাঁর মতো সপ্রতিভ, বেগমান মানুষ দ্বিতীয়টি চোখে পড়ে না। প্রশ্ন করেছিলাম, উত্তরে জানালেন, সিডনি তো বটেই প্যারিস, লন্ডন, নিউ ইয়র্ক কত ঘুরলাম, না রে ভাই, এমনটা হয় না। ঢাকার ঘিঞ্জি গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে মনে হয় কে যেন বুকের ভেতর ফুঁ দিয়ে গেল। প্রসারিত বক্ষদেশ, হাত উঁচু হয়ে পেঁৗছে গেল নীলিমার কাছাকাছি। পায়ের তলায় শক্তির প্রচণ্ডতা, এ অনুভূতি অন্য কোথাও মেলে না। একেই বলে দেশ। ভাবছেন, এসব কথার কথা, ফেনানো আবেগ, মোটেই তা নয়। মানুষ এক আশ্চর্য জীব! তার ভেতরের শক্তির পরীক্ষার জন্যও প্রয়োজন বৈরী পরিবেশ। আমাদের জাতির কথাই ভাবুন, কখন সে ঐক্যবদ্ধ? একাত্তরে চরম দুঃসময়ে। মিরপুরের মাঠে, হারতে হারতে জেতার সময় অথবা গো-হারা হেরে বাড়ি ফেরার চরম হতাশায়। এই অনুভূতি আবার সব জাতিতে সব দেশে পাওয়া যায় না, বস্তুতান্ত্রিক, আবেগের পরিবর্তে দেওয়া-নেওয়া আর পারস্পরিক বিনিময়ে বিশ্বাসী জাতিগুলো উন্নত ধনী, সচ্ছল অগ্রগামীও বটে। কিন্তু তার ভেতর এ জাতীয় বোধগুলো কাজ করে না। তাই ভাবতে বাধ্য হই, এত দুর্বল, অনগ্রসর বিবদমান জাত হওয়ার পরও এই প্রেম বা ভালোবাসার উৎস কী?
সংস্কৃতিই মূলত আমাদের প্রধান হাতিয়ার। গেল হ্নায় সিডনি এসেছিলেন উপমহাদেশের প্রথিতযশা শিল্পী কিংবদন্তি আশা ভোঁশলে। সন্ধ্যার একটু আগে উপচেপড়া মিলনায়তনে সমবেত দর্শক-শ্রোতার সিংহভাগই ছিলেন ভারতীয়। টিমটিমে প্রদীপের মতো বাংলা গান শোনা ও আশা ভোঁশলেকে দেখার জন্য হাজির হয়েছিলাম আমরা। অর্থাৎ মুষ্টিমেয় বাংলাদেশি। ৭৭ বছর বয়সেও অসামান্য কণ্ঠ আর নাচে আসর মাতিয়ে দেন তিনি। প্রতি পরতে বুঝিয়ে দিয়েছেন প্রতিভার জাদু স্পর্শ কথাটি মিথ্যে কিছু নয়। এ বয়সে একা পারবেন না জেনে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন আরেক খ্যাতিমান গায়ক। বাঙালি হয়েও উপমহাদেশ কাঁপানো শিল্পী কিশোর কুমারের পুত্র অমিত কুমার। কুমারজী যেমন গাইয়ে, তেমনি নাচিয়ে। পাঠক নিশ্চয়ই রুমা গুহ ঠাকুরতার কথা ভুলে যাননি। গণনাট্য আন্দোলনের পর মেকং ভনগা ঘুরে পদ্মার চরে বিপ্লবের গান। ঘরে ঘরে সাম্যবাদ আর সমাজবাদের ফসল তুলে দেওয়ার সংগীতময় প্রচেষ্টা? সেই রুমা গুহ ঠাকুরতা ও কিশোর কুমারের ছেলে অমিত কুমারকে দেখে বা গান শুনে বোঝার উপায় নেই তিনি বাঙালি। যে দু-এক ছত্র বাংলা বলেছেন, গাইবার চেষ্টা করেছেন, তাতে বরং মনে পড়েছে 'একদিন বাঙালি ছিলাম রে'। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের এ এক নিদারুণ ক্রান্তিকাল। সে দেশে আঞ্চলিকতার সীমানা ডিঙাতে হলে হিন্দির দ্বারস্থ হওয়ার বিকল্প নেই। যে রাষ্ট্রে বাংলা একটি অঞ্চল, সেখানে বাঙালি সংস্কৃতির আরাধনা বা চর্চায় আঞ্চলিক তো হতেই হবে। আশা ভোঁশলের ব্যাপারটা ভিন্ন। তিনি জন্মসূত্রে বাঙালি না হয়েও বাংলা গানে তাঁর স্বকীয়তায় অনন্য। অবশ্য বৈবাহিক সূত্রে তিনিও বাঙালি। সংগীতসন্ধ্যাটিতে ঘরে ফিরে উচ্চারিত কায়াহীন ছায়ায় মহিমান্বিত কণ্ঠস্বর ছিলেন প্রয়াত আর ডি বর্মণ, রাহুল দেব বর্মণ তো সেই শচীন দেবেরই পুত্র। যাঁর কণ্ঠ শুধায় বাংলা গান অতীতের মতো আজও এক প্রমত্তা পদ্মা। শচীন কর্তার প্রেম ও বিরহের গান আজকের তারুণ্যেও সমান জনপ্রিয়। তরুণী বন্ধুটি যখন আমাকে শচীন কর্তার পঙ্ক্তি লিখে শুভেচ্ছা জানায়, 'শোন গো দখিন হাওয়া' বলে ডাক দেয়, আমি বিস্মিত হলেও আকুল হয়ে উঠি। পরম্পরার স্রোতে ক্রমাগত উজ্জ্বল হয়ে ওঠা শচীন দেবের সঙ্গে জেগে ওঠেন তাঁর সহধর্মিণী মীরা দেব বর্মণ। বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতের মতো অসংখ্য গানের প্রতিভাময়ী মীরার শেষ সময়টুকু খুব একটা সুখের কিছু ছিল না, পতি প্রয়াত, একমাত্র সন্তান রাহুলও গত, শেষ আশ্রয় পুত্রবধূ আশা ভোঁশলে। কিন্তু আশার মতো নামি গায়িকার কি শাশুড়ি সেবা বা দেখভালের সময় আছে? ফলে মীরা দেব বর্মণকে আশ্রয় নিতে হয়েছিল ওল্ড হোমে, বৃদ্ধাশ্রমে, সে নিয়ে অনেক হৈচৈ। লেখালেখি। মিডিয়ার তাড়নায় ফিরিয়েও আনতে হয়েছিল গৃহকোণে। কিন্তু সে শোক কি ভোলার মতো? বেশি দিন বাঁচেননি তারপর। আশা ভোঁশলের বিষাদ মাখানো কণ্ঠস্বর, বেদনার সুর যখন সিডনি অলিম্পিক সার্কের বিশ্বসেরা অডিটরিয়ামের ছাদ ভেঙে আকাশে মেলানোর জন্য অস্থির, কম্পিউটার কল্যাণে পর্দায় ভেসে ওঠা বয়সের বলিরেখা দেখে কেন জানি মীরা দেব বর্মণকেই মনে পড়ছিল। নিয়তি ও প্রকৃতি কি কাউকে ছেড়ে কথা বলে? সে সন্ধ্যায় আরো একটি অনুভূতি তাড়া করে ফিরছিল। বাঙালি হওয়ার হাজার বিপদ বা ঝুঁকি থাকার পরও নিজেকে মনে হচ্ছিল তৃপ্ত ও গর্বিত। পশ্চিমবঙ্গের সমবেত বাঙালি শ্রোতারা একটু পরপরই হাঁক দিচ্ছিলেন 'বাংলা চাই, বাংলা'। একে থাকেন প্রবাসে, তার ওপর আশা ভোঁশলে ও অমিত কুমার, 'বিনা স্বদেশি ভাষা পুরে কি আশা?' সে তৃষ্ণা মেটানোর জন্য গলা খাঁকারি দিতে হচ্ছে তাঁদের। ২০০০ সালে মান্না দে এসেছিলেন সিডনি কনসার্টে। অকুণ্ঠচিত্তে জানিয়ে গিয়েছিলেন, 'বহির্বিশ্বে বাংলা গানের শ্রোতা-দর্শক বাংলাদেশিরাই বাংলা গানের শেষ ভরসা।' মান্না দে এটাও বলেছিলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে বাংলা গানের দুর্দশার অন্ত থাকত না। তাঁর মতো গায়কের এ জাতীয় মন্তব্যের পর কথা চলে না। সে সন্ধ্যায় ঠিক তারই প্রমাণ, ভবিষ্যদ্বাণীর প্রতিফলন প্রত্যক্ষ করলাম। সঙ্গে এও জেনেছি, আমাদের সংস্কৃতি, সংস্কৃতিবোধ বাংলা শিল্প-সংস্কৃতির ঐতিহ্য বর্তমান ও ভবিষ্যৎ একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে একাকার। এর দায়িত্ব, পতাকা বহনের ভারও আমাদের। একটি মাত্র বাংলা গানে আশা ভোঁশলেকে খুঁজে পাইনি। পাইনি বাংলা চর্চায় অনভ্যস্ত অমিত কুমারকে। মনে হলো বাংলা জেগে আছে শুধু এ প্রান্তে, উন্মত্ত পদ্মার শান্ত-অশান্ত স্রোতধারায় প্রবহমান জীবনে, রক্ত ও অস্থিমজ্জায় সে ধারা বহনকারী বাংলাদেশিরাই দেশে-বিদেশে তার প্রহরী। স্বাধীনতার এই মাস অর্থাৎ মার্চে, সব তুচ্ছ ঘটনা, রাজনীতির দুর্বিষহ কঠিন মান-অপমান আর উন্মাদনা সরিয়ে দেখলে এ সত্য অনায়াসে চোখে পড়বে এবং এই আমাদের গৌরব পালক। আমাদের জাতির শিরপ্রাণে গোঁজা বিজয়ের ফুল, স্বাধীনতার আনন্দ-কুসুম।

লেখক : সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক
dasguptaajoy@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.