বেঙ্গল গ্যালারি-শ্রেণীহীন মানবজাতির চিত্রভাষ্য by জাফরিন গুলশান

‘নীলিমায় কয়েকটি পায়রা আলোর ঢেউ তুলে তুলে ভ্রান্ত কালে নিজেরাই ঢেউ হয়/ ঢেউ থেকে ক্রমাগত রক্তধারা বয়।’
একটি চিত্রপটের চারপাশে ঘূর্ণমান শব্দগুলোর মধ্যকার তিনটি মানব চরিত্রের অভিব্যক্তি ও গতি স্বয়ংসম্পূর্ণ শক্তিমান হয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে অস্থির রাজনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতায়।


শোষিত, বঞ্চিত, আহত কিন্তু উজ্জীবিত জীবনের কথা বলেছেন শিল্পী বিজন চৌধুরী। শিল্পী গণসংহতি জানিয়েছেন মানব সভ্যতার সুদিনের সংগ্রামে। তাঁর চিত্রপট একবাক্যে অনেক বেশি ‘বাংলার’। এপার থেকে ওপার বাংলায় তাঁর ব্যক্তিগত পারাপারের মতোই দুই বাংলার একীভূত অভিজ্ঞতার নান্দনিক শিল্প সঞ্চালন। যে ৩৩টি চিত্রকর্ম নিয়ে বেঙ্গল গ্যালারি অব ফাইন আর্টস ‘শ্রদ্ধার্ঘ্য বিজন চৌধুরী’ শিরোনামে প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে, সেগুলো গদ্যময়। বর্ণনামূলক। কোথাও কোথাও গীতি কবিতার মতো আচরণ করে। কিন্তু ইলাস্ট্রেটিভ গুণবর্জিত। শিল্পী বিজন চৌধুরী বাংলাদেশের ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ঢাকা চারুকলার প্রথম ব্যাচের ছাত্র। যদিও কলকাতার কালীঘাট অঞ্চলে বেড়ে উঠেছেন। ফলে তাঁর শিল্পকর্মগুলোর আঙ্গিকগত নির্মাণে কালীঘাট অঞ্চলের শিল্পশৈলীর সচেতন ও সুনির্বাচিত প্রভাব। কখনো রং লেপন কিংবা চিত্রপটের চরিত্রের নির্মাণ প্রাচ্য রীতির। সারা জীবন বামপন্থী রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী ও নতুন সমাজব্যবস্থার স্বপ্নে শ্রেণীহীন মানবজাতির জন্য কাজ করে গেছেন। ছবিতে তাই বাঙালি জীবনের সাধারণ চিত্র। কিংবা যোদ্ধার বেশে অবতীর্ণ মানুষ। অনেকটা ত্রিমাত্রিক ও জ্যামিতিক। ভাস্কর্যের আদল গড়ে উঠেছে শক্তিশালী আঙ্গিকের ভিন্ন ভিন্ন তলে রঙের লেপনে। পৌরাণিক কাহিনিকে নিজ অনুভবে ও দর্শনে একীভূত করে গল্প তৈরি করেছেন। রোমান্টিসিজমের আবেশে জড়ানো সামাজিক বাস্তবতা ও পৌরাণিক ভাবচিন্তার সংশ্রব। ছবিতে ডাইমেনশন তথা মাত্রা আনয়ন ঘটেছে সরা চিত্রের আদলে। তুলির টান এবং ফিনিশিং লাইনে পটুয়াদের মতো সরলতা বিদ্যমান। কিন্তু অত্যন্ত বলিষ্ঠ ড্রইং। রং নির্বাচনে অনুজ্জ্বল বর্ণবিভাজন লক্ষণীয়। রমণীর গার্হস্থ্য জীবন, নারী-পুরুষের প্রেমঘন মুহূর্ত, বাউল জীবনের রস, সংগীতের সুরমূর্ছনা, বীরযোদ্ধার প্রত্যাবর্তন—এসব চরিত্র ও গুণাবলি সহজভাবে মনোমুগ্ধকর।
রয়েছে রূপকের সমাধান।
‘ঘোড়া’ এসেছে বারবার। ঘোড়ার ক্ষিপ্রতা জীবনের দুর্দমনীয় গতিকে ধারণ করে। অধিকাংশ ছবি শিরোনামহীন।
শিল্পী হয়তো বা নাম দিয়ে দর্শককে পরাধীন করতে চাননি তাঁর চিন্তায়। আত্মবিশ্বাসীভাবে শিরোনামহীন ছবিগুলো প্রাণবন্ত দর্শকের সঙ্গে যোগাযোগে। বিবিধ পরিপ্রেক্ষিতের ব্যবহার চিত্রপটের বিভিন্ন আঙ্গিককে ছন্দোবদ্ধ করেছে প্রজ্ঞায়। বিজন চৌধুরী সংগীতপ্রিয় ব্যক্তি। ছবিতে তাই সংগীতের আবহ নির্মাণ করেছেন। চিত্রগুলো স্বাপ্নিক। বাস্তবিক রূঢ়তা ছাপিয়ে অবশ্যম্ভাবী সুদিনের স্বপ্ন দেখান তিনি দর্শককে। তাঁর সার্থকতা মানুষ হিসেবে, একজন সার্থক শিল্পী হিসেবে এখানেই। প্রদর্শনীটি ২২ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত চলবে।

শিল্পী বিজন চৌধুরী জন্ম: ১৯৩১ সালে বাংলাদেশের ফরিদপুরে। তিনি ১৯৪৫ থেকে ৪৯ সাল পর্যন্ত কলকাতার গভর্নমেন্ট কলেজ অব আর্ট অ্যান্ড ক্রাফটসে শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি ঢাকার তৎকালীন গভর্নমেন্ট কলেজ অব আর্ট অ্যান্ড ক্রাফটস (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ) থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে বিএফএ ডিগ্রি লাভ করেন। এ পর্যন্ত তাঁর চারটি একক প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছে এবং বহু দলবদ্ধ প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন। তিনি ১৯৬৩ সালে কলকাতার একাডেমি অব ফাইন আর্টস অ্যাওয়ার্ড, ১৯৭৮ সালে রবীন্দ্রভারতী অ্যাওয়ার্ড,
১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী প্রদত্ত বাংলাদেশের শিল্পকলা চর্চার ৫০ বছর পূর্তি সম্মাননাসহ আরও অনেক পুরস্কার লাভ করেন। তিনি ১৯৭৬ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত কলকাতার ইন্ডিয়ান কলেজ অব আর্ট অ্যান্ড ড্রাফটসম্যানশিপে অধ্যক্ষ ছিলেন। বিজন চৌধুরী গত ১৬ মার্চ ২০১২ কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

No comments

Powered by Blogger.