ডেসটিনির সব ব্যাংক হিসাব স্থগিত-৫ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন পরিচালকেরা by ফখরুল ইসলাম

ডেসটিনি গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিপুল পরিমাণ টাকা পরিচালকেরা তুলে নিয়ে যাওয়ার পর প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংক হিসাব স্থগিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানগুলোতে এযাবৎ প্রায় পাঁচ হাজার ৯৬১ কোটি টাকা জমা হয়েছে, যা থেকে চার হাজার ৯০০ কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন চেয়ারম্যান মো. রফিকুল আমীনসহ পরিচালক ও শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা।


বিভিন্ন ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেওয়ার এ তথ্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে রয়েছে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক মানি লন্ডারিংবিষয়ক এবং এনবিআর রাজস্ব ফাঁকিবিষয়ক আলাদা প্রতিবেদন তৈরি করছে।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে ডেসটিনির পরিচালকদের এ টাকা তুলে নেওয়ার ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক কি এটা জানে! তবে টাকা তুলে নিয়ে গেলেও এর প্রমাণ থাকবে। তাদের ধরাও যাবে।’ অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, ‘বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে এখনো পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পাইনি। তাই কমিশন গঠনে দেরি হচ্ছে। আমরা ওই প্রতিবেদনটির জন্য অপেক্ষা করছি।’
এনবিআরের সদস্য মোহাম্মদ আলাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা টাকা-পয়সা সরালে সরাতে পারেন। তবে জবাবদিহির মধ্যে আসতে হবে। টাকা সরালেও ব্যবস্থা নিতে কোনো সমস্যা হবে না। কারণ, প্রমাণপত্র কিছুই তো মুছে যাবে না।
যোগাযোগ করা হলে ডেসটিনির চেয়ারম্যান রফিকুল আমীন টাকা তুলে নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, গণমাধ্যম এগুলো ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রচার করছে।
ব্যাংক হিসাব স্থগিত: ডেসটিনি গ্রুপের ৩৭টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩৫টির ব্যাংক হিসাব এক মাসের জন্য স্থগিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইনান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট থেকে এ স্থগিতাদেশ দিয়ে দেশের ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের কাছে গতকাল চিঠি পাঠানো হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, ‘বৈশাখী টেলিভিশন ও দৈনিক ডেসটিনি পত্রিকা ছাড়া ডেসটিনি গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠান, প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালক এবং তাঁদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সব ধরনের ব্যাংক হিসাব মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ অনুযায়ী স্থগিত করা হলো।’
এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ডেসটিনি গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শুধু ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের নামেই ব্যাংকে জমা হয়েছে তিন হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে তুলে নেওয়া হয়েছে তিন হাজার ৫৯০ কোটি টাকা।
ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশনের নামে পাঁচটি বেসরকারি ব্যাংকে জমা হয়েছে ৯২১ কোটি টাকা। তা থেকে পরিচালকেরা তুলে নিয়ে গেছেন ৯০০ কোটি টাকা।
এইচএসবিসির প্রধান শাখায় বেস্ট এভিয়েশনের নামে জমা হয়েছে ১৯৩ কোটি টাকা। এর পুরো টাকাই তুলে নেওয়া হয়েছে। একই শাখায় এই প্রতিষ্ঠানের নামে ৬৭ কোটি টাকার স্থায়ী আমানতও (এফডিআর) রয়েছে।
সাউথইস্ট ব্যাংকে ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশনের নামে থাকা ব্যাংক হিসাব থেকে ১১ কোটি ২৬ লাখ টাকা তুলে নিয়ে গেছেন ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের ডিএমডি মোহাম্মদ গোফরানুল হক।
আরেক পরিচালক মেজবাহউদ্দিন স্বপন তুলে নিয়ে গেছেন আট কোটি ২৩ লাখ টাকা। ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের চেয়ারম্যান সাঈদ-উর-রহমান ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশন, ডেসটিনি ২০০০ এবং সপ্তক অনলাইন প্রাইভেট লিমিটেডের নামে থাকা ব্যাংক হিসাব থেকে তুলে নিয়ে গেছেন চার কোটি ৫৩ লাখ টাকা। ডেসটিনি গ্রুপের চেয়ারম্যান রফিকুল আমীন তুলে নিয়েছেন এক কোটি ৭৭ লাখ টাকা। লে. কর্নেল (অব.) দিদারুল আলম নিয়েছেন ৩৩ লাখ টাকা।
মূসক ও আয়কর ফাঁকি: ডেসটিনি গ্রুপের মধ্যে শুধু ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের কর ও মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ফাঁকি উদ্ঘাটন করেছে এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি)। এই কোম্পানিটি একাই ১৫৭ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। এর মধ্যে ৮৪ কোটি টাকা মূসক ও ৭৩ কোটি টাকা আয়কর।
যোগাযোগ করা হলে এনবিআরের সদস্য মোহাম্মদ আলাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, রাজস্ব ফাঁকির বিরুদ্ধে দুই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়ে থাকে। একটি হলো জরিমানাসহ পাওনা আদায়, অন্যটি আইনি পদক্ষেপ। বিষয়টি এখন কমিশনারদের জানিয়ে দেওয়া হবে। ফাঁকির সমপরিমাণ অর্থ জরিমানা করার বিধানও রয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তাগাদা: যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরকে (রেজসকো) গতকাল আবারও পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিলের জন্য তাগাদাপত্র পাঠিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
রেজসকো নিবন্ধক ও ডেসটিনির অনিয়ম-দুর্নীতি উদ্ঘাটন বিষয়ক গত ফেব্রুয়ারিতে গঠিত সাত সদস্যের কমিটির প্রধান আহমেদুর রহিমকে অবিলম্বে প্রতিবেদন দাখিলের কথা বলেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
এতে বলা হয়েছে, ডেসটিনি গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো সংঘস্মারকে উল্লিখিত উদ্দেশ্য অনুযায়ী ব্যবসা করছে কি না, এদের ব্যবসা পরিচালনার পদ্ধতির আইনগত ভিত্তি আছে কি না, অবৈধ আর্থিক লেনদেন করছে কি না ইত্যাদি জানাতে বলা হয়েছিল। কিন্তু এখনো তা মন্ত্রণালয়কে জানানো হচ্ছে না এবং পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিল করা হচ্ছে না।

No comments

Powered by Blogger.