গোলটেবিল বৈঠক‘শিশুদের জন্য বিনিয়োগ ও সরকারের অঙ্গীকার’-বাজেটে শিশুদের জন্য পৃথক অধ্যায় চাই

বিভিন্ন মন্ত্রণালয় শিশুদের জন্য পৃথক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। বাজেটে এসব কর্মসূচির জন্য বরাদ্দও রাখা হচ্ছে। কিন্তু বাজেটের কত শতাংশ শিশুদের জন্য বরাদ্দ থাকছে, তার সুস্পষ্ট হিসাব নেই। শিশুদের জন্য কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলো কি না, তা জানারও কোনো ব্যবস্থা নেই।


এসব বিষয় নিশ্চিত করতে বাজেটে শিশুদের জন্য আলাদা একটি অধ্যায় দরকার।
গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলো আয়োজিত ‘শিশুদের জন্য বিনিয়োগ ও সরকারের অঙ্গীকার’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা এ কথা বলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, সেভ দ্য চিলড্রেন ও সিএসআইডি এ বৈঠক আয়োজনে সহায়তা করে। প্রথম আলোর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে শিশুদের জন্য বিনিয়োগের বিষয়ে কেউ দ্বিমত প্রকাশ করেননি। কিন্তু বিনিয়োগের ধরন ও প্রক্রিয়া নিয়ে নানা মত পাওয়া যায়।
সঞ্চালক ও প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম বৈঠকের শুরুতে বলেন, বাজেটে একটি অধ্যায়ে শিশুর বরাদ্দ আলাদাভাবে থাকলে তাতে নজরদারি করা সুবিধা হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান বলেন, বাজেটে শিশুদের জন্য আলাদা অধ্যায়ের দাবি যুক্তিসংগত নয়। জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদনের মতো শিশুদের জন্য সহায়ক দলিল হতে পারে। তিনি বলেন, বাজেটের সময় দেশের শিশুরা কেমন আছে, সে ধরনের সার্বিক প্রতিবেদন জাতীয় সংসদে উত্থাপন করতে হবে। এতে শিশুদের অবস্থানের তুলনামূলক আলোচনা থাকবে। এ থেকে সমস্যা চিহ্নিত করে কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। এ কর্মপরিকল্পনার সঙ্গে বাজেট বরাদ্দের সমন্বয় করতে হবে।
আকবর আলি খান আরও বলেন, বাজেটে শিশুদের জন্য সরাসরি কত ব্যয় হচ্ছে, তা বের করা হয়তো সম্ভব, কিন্তু তা দিয়ে তেমন লাভ হবে না। শিশুদের অধিকার রক্ষায় প্রশাসনিক তৎপরতা বাড়ানো ও প্রশাসনকে বিকেন্দ্রীকরণের সুপারিশ করেন তিনি।
তথ্য কমিশনার সাদেকা হালিম বলেন, জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদন অনেক সংগ্রামের ফসল। হয়তো তাতে অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। তার পরও নারীর হিস্যাটি কিছুটা হলেও স্পষ্ট হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বাজেট বরাদ্দের চেয়েও তা বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, শিক্ষা বাজেটের ৬০ শতাংশই ব্যয় করা হচ্ছে শিশুদের জন্য। এতে আসলে কী লাভ হচ্ছে, তা দেখতে হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মো. এম এ মান্নান বলেন, বাজেটে শিশুদের হিস্যাটি আলাদাভাবে বিভাজন করে দেখানো সম্ভব নয়। তবে বাজেট বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে শিশুরা যাতে বেশি লাভবান হয়, উপবৃত্তি যাদের পাওয়ার কথা, তারা পাচ্ছে কি না, বিনোদনের পেছনে বিনিয়োগ হচ্ছে কি না, সেই বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, শিশুদের জন্য যে বিনিয়োগ করা হচ্ছে, তা যথেষ্ট নয়। তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে শিশুদের পরিচিত করানোর জন্যও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব রণজিৎ কুমার বিশ্বাস বলেন, শিশুদের জন্য বিনিয়োগ ক্ষেত্রে সরকারের অঙ্গীকার নিয়ে সন্দেহ করার কিছু নেই। সরকার জানে, শিশুর পেছনে বিনিয়োগ না করলে যে ক্ষতি হয়, তার মূল্য অনেক বেশি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা বিভাগের প্রধান ফাহমিদা খাতুন বলেন, আদমশুমারিতে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু ধরা হচ্ছে। আবার সরকারের কিছু কিছু নীতিতে ১৮ বছরের কম বয়সীদের শিশু বলা হচ্ছে। ফলে মোট জনসংখ্যার মধ্যে শিশুর সংখ্যা কোথাও বলা হচ্ছে ৩০ শতাংশ, আবার কোথাও ৪৫ শতাংশ। তিনি বলেন, যেকোনো পরিকল্পনা করার আগে সঠিক তথ্য জানাটা জরুরি।
জাতিসংঘ শিশু তহবিলের শিশু সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ এম এম আমিনুল ইসলাম বলেন, শিশুদের ক্ষেত্রে বৈষম্যগুলো চিহ্নিত করে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বাজেটে বরাদ্দ রাখতে হবে।
সেভ দ্য চিলড্রেনের দেশীয় উপপরিচালক (প্রোগ্রাম ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কোয়ালিটি) কাজী গিয়াস উদ্দিন বলেন, বাজেটে যে বরাদ্দ আছে, তাতে শিশু কত শতাংশ পাচ্ছে, তা জানার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কারণ, দাতারা প্রায়ই জানতে চায়, সরকারের রাজস্ব বাজেটে শিশুদের জন্য কত বরাদ্দ আছে। সেভ দ্য চিলড্রেনের উপপরিচালক (চাইল্ড রাইটস গভর্ন্যান্স প্রোগ্রাম) শামসুল আলম বলেন, শিশুদের চাহিদা আলাদা বলেই জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ তৈরির প্রয়োজন পড়ে। তাই এদের জন্য যে বিনিয়োগ, সেটি স্পষ্ট না হলে তা বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে নজরদারি করা সম্ভব হবে না।
সিএসআইডির নির্বাহী পরিচালক খন্দকার জহুরুল আলম বলেন, ভারত, ঘানা, ব্রাজিলসহ বিভিন্ন দেশেই বাজেটে শিশুদের জন্য আলাদা অধ্যায় আছে। তাই এ দেশের বাজেটেও শিশুদের জন্য আলাদা অধ্যায় এবং তাতে নজরদারির জন্যও প্রক্রিয়া নির্ধারণ করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম বলেন, শিশুদের জন্য শুধু বরাদ্দ দিলেই হবে না, বিষয়টিকে দেখতে হবে বিনিয়োগ হিসেবে। এ বিনিয়োগের ফলে যে মুনাফা হলো, তার হিসাবও করতে হবে।
চাইল্ড রাইটস গর্ভন্যান্স অ্যাসেম্বলির আহ্বায়ক এমরানুল হক চৌধুরী বাজেট তৈরির আগে শিশুদের মতামত নেওয়া এবং শিশুদের জন্য আলাদা অধিদপ্তর তৈরির ওপর গুরুত্ব দেন।
সেভ দ্য চিলড্রেনের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক (চাইল্ড রাইটস গভর্ন্যান্স প্রোগ্রাম) চৌধুরী মো. তাইয়ুব তাজাম্মুল বলেন, বাজেটের ফলাফলভিত্তিক মূল্যায়ন করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা থাকা দরকার।

No comments

Powered by Blogger.