নাকুগাঁও গণহত্যা দিবস by দেবাশীষ ভট্টাচার্য

দীর্ঘ নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিশ্বমানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের ২৫ মে হানাদার ও তাদের দোসর রাজাকার বাহিনী এক নৃশংস ও বর্বরোচিত হামলা চালায় শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার নয়াবিল ইউনিয়নের নাকুগাঁও সীমান্ত এলাকায় (বর্তমানে নাকুগাঁও স্থলবন্দর)।


অতর্কিত হামলায় নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় কয়েকশ' মানুষকে। আজ নাকুগাঁও গণহত্যা দিবস। স্বাধীনতাউত্তর দেশের বিভিন্ন স্থানে শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ বা স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হলেও অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে নাকুগাঁও বধ্যভূমি। দীর্ঘ ৪০ বছরেও এখানে নির্মিত হয়নি কোনো স্মৃতিফলক বা স্মৃতিস্তম্ভ। ইতিমধ্যেই বধ্যভূমির অনেক স্থান ভোগাই নদীর গর্ভে তলিয়ে গেছে।
২৫ মার্চ ঢাকা ও অন্যান্য স্থানে গণহত্যা শুরুর পর হাজার হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল সীমান্তবর্তী ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বারেঙ্গাপাড়া, চান্দুভূই, ডালু বাজার, মাছংপানি, ছৈপানি, ডিমাপাড়াসহ বিভিন্ন জায়গায়। ২৫ মে হঠাৎ পাকবাহিনী নাকুগাঁও আক্রমণ করে।
নিহতদের মধ্যে ছিলেন আবদুুল মোতালেব ও আশফাকুর রহমান। তাদের বিএসএফ বাহিনী নাকুগাঁও সীমান্তে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বর্তমানে দক্ষিণ গারোহিল এলাকায় দাফন করেছে। শহীদ আবদুুল মোতালেব ছিলেন শেরপুরের সাবেক এমপি মরহুম নিজাম উদ্দিন আহম্মেদের ছোট ভাই। তিনি নববধূকে ঘরে রেখে 'জীবন থেকে নেয়া' ছবিটির প্রিন্ট সঙ্গে নিয়ে ভারতে গিয়েছিলেন। এ ছবিটি ভারতের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের অর্থ সংগ্রহ কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল। তার লেখা একটি চিঠি ও তার ছবি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। পারিবারিকভাবে তার স্মৃতি রক্ষার্থে শেরপুর সদরে গ্রামের বাড়ি মান্দাখালীতে নির্মাণ করা হয়েছে একটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। শহরে পৌর কর্তৃপক্ষ একটি রাস্তার নামকরণ করেছে তার নামে।
শহীদ আশফাকুর রহমানের পকেটে একটি ছবি পাওয়া যায়। ছবিতে দেখা যায়, তিনি ঘরোয়া পরিবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদকে খাবার পরিবেশন করছিলেন। এ ছাড়াও শহীদদের মাঝে যাদের নাম পাওয়া গেছে তারা হলেন_ নুর ইসলাম (ইপিআর), নুরুজ্জামান (পুলিশ), রিয়াজ সরকার, আশরাফ আলী, হযরত আলী, নরেন সাধু, নরেন শীল, নৃপেন দে, ফনীন্দ্র দাস, অশ্বিনী দাস, আব্বাস সরকার ও তার অষ্টাদশী মেয়ে এবং ৮ মাসের ছেলে।
দীর্ঘ ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে শহীদ হন মুক্তিযোদ্ধাসহ অসংখ্য নিরীহ মানুষ। এসব শহীদের অনেকেই ঘুমিয়ে আছেন নাকুগাঁও বধ্যভূমিতে। কিন্তু এ নাকুগাঁও বধ্যভূমিতে কোনো স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়নি। অথচ সীমান্ত ঘেঁষে ভারতীয়রা শহীদদের স্মরণে অনেক আগেই স্মৃতিফলক নির্মাণ করেছে। ১৯৮৮ সালে তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান একেএম বেলায়েত হোসেন খসরু ও ১৯৯২ সালের ২৭ জুন জেলা প্রশাসক এখানে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। অজ্ঞাত কারণে সে কাজে অগ্রগতি হয়নি। ১৯৯৭ সালে তৎকালীন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম সিদ্দিক সরেজমিন এই গণকবরের করুণ হাল দেখে দ্রুত একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের মৌখিক নির্দেশ দিলেও অদ্যাবধি কোনো কাজ হয়নি। নাকুগাঁও গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আমির ফকির জানান সেদিনের ভয়াল স্মৃতির কথা। এ দেশের মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুমুক্ত করার জন্য প্রাণ বাজি রেখে যুদ্ধ করেছে। আমিও দৃঢ়চিত্তে যুদ্ধ করেছি। দুর্ভাগ্য আমাদের, ৪০ বছরেও দেশমাতৃকার জন্য আত্মদানকারী বীর শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করতে পারিনি। তিনি বলেন,
পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এটি খুবই প্রয়োজন ছিল।
 

No comments

Powered by Blogger.