চট্টগ্রামে কুকুর লেলিয়ে 'হিমু হত্যা'-মূল নির্যাতক লন্ডনে পালিয়েছে by রফিকুল বাহার ও ভূঁইয়া নজরুল

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবান আর খাওয়া হলো না ১৭ বছরের মেধাবী ছাত্র হিমাদ্রী মজুমদার হিমুর। এর আগেই সহপাঠীরা শারীরিক নির্যাতনের পর জার্মান 'ডোবারম্যান' জাতের হিংস্র কুকুর লেলিয়ে ওকে মেরে ফেলেছে। সন্তান হারিয়ে বাবা প্রবীর কান্তি মজুমদার শোকস্তব্ধ।


আর নির্যাতন চালানোদের অন্যতম রিয়াদ নিজেকে বাঁচাতে ঘটনার দিনই পালিয়েছে লন্ডনে। আর এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলা নিয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে গাছাড়া ভূমিকার অভিযোগ উঠেছে।
হিমুকে ধরে নিয়ে প্রথমে শারীরিক নির্যাতন, এরপর হিংস্র কুকুর লেলিয়ে দেওয়া, পরে চার তলা ভবনের ছাদ থেকে নিচে ফেলে দেওয়া, চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু- পুরো ঘটনায় মূল নির্যাতকের ভূমিকাটি জুনায়েদ আহমেদ রিয়াদের। তার বাবা গাড়ি আমদানিকারকদের সংগঠন বারভিডার সাবেক নেতা শাহ সেলিম টিপু কালের কণ্ঠের কাছে ছেলেকে লন্ডনে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, 'ঘটনার সময় আমি মসজিদে জুমার নামাজ পড়ছিলাম। তাই কিছুই জানি না। তবে আহত হিমুকে দেখতে গেলে সে জানায় যে তাকে কুকুর লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল।' নিজের ছেলে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, 'রিয়াদ পড়াশোনার জন্য এখন লন্ডনে।' তাহলে কারা কিভাবে তাঁরই ভবনের ছাদে একজন মেধাবী ছাত্রকে এভাবে কুকুর লেলিয়ে দিয়েছে, সে সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না বলে দাবি করেন।
গত ২৮ এপ্রিল থানায় সাধারণ ডায়েরি এবং বুধবার হিমু মারা যাওয়ার পর মামলা হলেও গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করেনি। পুলিশের এমন নিরাসক্ত ভূমিকা নিয়ে ইতিমধ্যে নানা অভিযোগ আর প্রশ্ন উঠেছে। কারণ ঘটনার পর সাধারণ ডায়েরি হওয়ার পরও প্রকৃত দোষীদের জিজ্ঞাসাবাদের কোনো উদ্যোগ নেয়নি পুলিশ।
মামলার কথা স্বীকার করে পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলমগীর হোসাইন বলেন, '৩০২/৩৪ ধারায় হত্যা মামলা নেওয়া হয়েছে। লাশের ময়নাতদন্ত হয়েছে। প্রাথমিক অভিযোগ পাওয়ার পর ঘটনার তদন্ত হয়েছিল। এখন আবার তদন্ত হবে।' আসামি গ্রেপ্তার না হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'গতকাল দুপুরে মামলাটি নেওয়া হলো। এখন তদন্ত সাপেক্ষে উপযুক্ত প্রমাণ পাওয়া গেলে আসামিদের গ্রেপ্তার করা হবে।'
হিমাদ্রীর সহপাঠীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নগরের পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকার ১ নম্বর রোডে ইংরেজি মাধ্যম সামারফিল্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজে 'এ' লেভেলের শিক্ষার্থী হিমাদ্রী মজুমদার হিমু। ২৭ এপ্রিল রাউজানে এক আত্মীয়র বাড়িতে সহপাঠীসহ মেজবান খেতে দুপুরের মধ্যে মাস্টারমাইন্ড স্কুলের ন্যাশনাল কারিকুলাম ভবনের মোড়ে জড়ো হওয়ার কথা ছিল। হিমাদ্রী নির্ধারিত সময়ের আগে এসে হাজির হলে ওত পেতে থাকা সাবেক তিন সহপাঠী তাকে জোর করে নিয়ে যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সহপাঠী জানায়, জুনায়েদ আহমেদ রিয়াদ, সাজু, ডেনি ও শাওন হিমুকে টানাটানি করে রিয়াদের বাসা মাস্টারমাইন্ড স্কুলের ন্যাশনাল কারিকুলাম ভবনের তৃতীয় তলায় নিয়ে যায়। এ সময় হিমু তার ঘনিষ্ঠ সহপাঠীদের ফোন করতে চাইলেও ওরা মোবাইল ফোনটি রাস্তায় ফেলে পা চাপা দিয়ে ভেঙে দেয়। ওরা বাসায় নিয়ে হিমুকে প্রচণ্ড মারধরের একপর্যায়ে চার তলার ছাদে নিয়ে যায়। ছাদে জার্মানির হিংস্র প্রকৃতির ডোবারম্যান জাতের পাঁচটি কুকুর রয়েছে। এ কুকুরগুলো হিমুকে কামড়ানোর জন্য লেলিয়ে দেয় রিয়াদ, সাজু, ডেনি ও শাওন। একপর্যায়ে ছাদের ওপর থেকে তাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেওয়া হয়। গুরুতর অবস্থায় প্রথমে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং পরে সার্জিস্কোপ হাসপাতালে হিমুকে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে সেখান থেকে তাকে ঢাকায় স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। ২৭ দিন ধরে চিকিৎসার পর বুধবার রাতে হিমু মারা যায়। মারা যাওয়ার আগে হিমু জবানবন্দি দিয়ে গেছে বলে জানা গেছে।
পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকার ১ নম্বর রোডের 'ফরহাদ ম্যানশন' নামের ১০১ নম্বর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, নিচতলা ও চতুর্থ তলা মাস্টারমাইন্ড ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ন্যাশনাল কারিকুলামের শ্রেণীকক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। দ্বিতীয় তলায় ভবনের মালিক ফরহাদ হোসেন ও তৃতীয় তলায় জুনায়েদ আহমেদ রিয়াদের বাবা শাহ সেলিম টিপু থাকেন। সিঁড়ি দিয়ে চতুর্থ তলার ছাদের মুখে যেতেই লোহার গ্রিলের ওপারে একটি কালো রঙের লেজকাটা জার্মানির ডোবারম্যান জাতের কুকুর তেড়ে আসে। তৃতীয় তলায় শাহ সেলিম টিপুর বাসায় কলবেল টিপতেই পাখি ও জাহানারা বেগম নামের দুই গৃহকর্মী বলেন, 'বাসায় কেউ নেই।' তবে তাঁরা জানান, ২০-২৫ দিন আগে শুক্রবার দুপুরে ছাদের ওপর থেকে একটি ছেলে পড়ে যায়। সে সময় বাড়ির কর্তার ছেলে রিয়াদ থাকলেও ওই দিন রাতেই সে লন্ডনে চলে যায়।
ঘটনার দিন হিমুকে প্রথমে উদ্ধার করা পাশের নির্মাণাধীন ভবনের নিরাপত্তাকর্মী মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, 'দুপুর ২টা থেকে আড়াইটার দিকে ওপর থেকে কিছু পড়ার শব্দ শুনে কাছে গিয়ে দেখি একটি ছেলে পড়ে আছে। পরে তাকে উদ্ধার করে মেডিক্যালে পাঠানোর ব্যবস্থা করি।'
কুকুর লেলিয়ে দিয়ে হত্যার কথা জানিয়ে মামলার বাদী ও হিমুর মামা প্রকাশ দাশ অসিত বলেন, 'আমার ভাগিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে শাহ সেলিম টিপুর ছেলে তাদের বাড়ির ছাদে নিয়ে গিয়েছিল। প্রথমে শারীরিক নির্যাতন ও পরে কুকুর লেলিয়ে নির্যাতনের একপর্যায়ে ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়। ২৩ দিন ধরে চিকিৎসাধীন থাকার পর হিমু বুধবার মারা যায়। এ ঘটনায় শাহ সেলিম টিপুসহ তাঁর ছেলে জুনায়েদ আহমেদ রিয়াদ, সাজু, ডেনি ও শাওনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে।'
সামারফিল্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক শিক্ষক প্রণমেশ বলেন, 'হিমুকে আমি পড়িয়েছি এবং তাকে ভালো ছেলে হিসেবেই জানি।'
এদিকে ছেলে হারিয়ে বাবা প্রবীর কান্তি মজুমদার শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছেন। অভিযোগ পাওয়া যায়, আসামিদের পক্ষ থেকে তার ছোট ছেলে লিনাদ্রী মজুমদারকে হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। লিনাদ্রী হিমুর স্কুলেই 'ও' লেভেলে পড়ছে। এক ছেলের বিচার চাইতে গিয়ে অপর ছেলেকে হারাতে চান না বলেও তিনি নিকটজনদের বলেছেন।
ছেলের মৃত্যু প্রসঙ্গে গতকাল হাসপাতাল মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে প্রবীর মজুমদার বলেন, 'প্রথমে সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছিল। এখন বিচারের জন্য মামলা করা হয়েছে। আজই (বৃহস্পতিবার) ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হবে।'
প্রসঙ্গত, কালের কণ্ঠে গতকাল প্রকাশিত প্রতিবেদনে ভুলক্রমে হিমুকে চিটাগং গ্রামার (সিজিএস) স্কুলের শিক্ষার্থী লেখা হয়েছিল। একসময় হিমু সিজিএসে পড়লেও সামারফিল্ড থেকে গত বছর 'ও' লেভেল পাস করে 'এ' লেভেলে ভর্তি হয়েছিল।

No comments

Powered by Blogger.