চাকরি ছাড়াটাই কি সমাধান

দেশের ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ বাস করে গ্রামাঞ্চলে। রাজধানী শহর, এমনকি জেলা শহরে এসে চিকিৎসা নেওয়ার ক্ষমতা তাদের অনেকেরই নেই। তাদের জন্য আছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙ্। কিন্তু শহরমুখী চিকিৎসকরা সেখানে যেতে চান না, থাকতে চান না। মাঝেমধ্যে গিয়ে কেবল সই করে আসেন। এমন অভিযোগ অনেক পুরনো।


তারই সূত্র ধরে প্রধানমন্ত্রী বলতে বাধ্য হয়েছেন, গ্রামে থাকতে ভালো না লাগলে চাকরি ছেড়ে দিন। কারণ এর আগে বারবার তিনি গ্রামের মানুষের দুঃখ-দুর্দশার চিত্র তুলে ধরে চিকিৎসকদের গ্রামে যেতে বলেছেন, গ্রামে থাকলে পদোন্নতিতে অগ্রাধিকারের ঘোষণা পর্যন্ত দিয়েছেন; কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছিল না। তাই শেষ পর্যন্ত তাঁকে রূঢ় হলেও সত্য আহ্বানটিই জানাতে হয়েছে।
গ্রামে যেতে চিকিৎসকদের এই অনীহার কারণে গ্রামের মানুষ কেবল যে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তা-ই নয়, বাধ্য হয়ে তাদের হাতুড়ে ডাক্তার বা টোটকা চিকিৎসার শরণাপন্ন হতে হচ্ছে। উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে বহু অকাল মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙ্রে অকর্মণ্যতার সুযোগ নিয়ে উপজেলায়ও এখন ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে ক্লিনিক ব্যবসা কিংবা ডায়াগনস্টিক সেন্টার। অনুমোদনহীন এসব ক্লিনিকের বহু অবাঞ্ছিত ও হৃদয়বিদারক ঘটনার খবর আমরা প্রায়ই পত্রিকার পাতায় দেখে থাকি। ভুয়া ডাক্তারের খবরও ছাপা হয়। তার পরও এসব ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো বছরের পর বছর এই অনৈতিক ব্যবসা চালিয়ে আসছে। গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র মানুষ তবু এদের কাছেই যেতে বাধ্য হয়। রোগনির্ণয় কেন্দ্রগুলোরও একই অবস্থা। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কোনো টেকনিশিয়ান নেই। মানসম্মত ইনগ্রেডিয়েন্ট বা পরীক্ষণ-উপাদান নেই। যা আছে, তা-ও দেখা যায় সাত-আট বছরের মেয়াদোত্তীর্ণ। কাজেই এসব কেন্দ্রের রিপোর্টে রোগের সঠিক কারণ চিহ্নিত হয় না।
আবার এটাও সত্যি, কেবল চিকিৎসকদের অনুপস্থিতিই গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র মানুষের সরকারি স্বাস্থ্যসেবা না পাওয়ার একমাত্র কারণ নয়। অধিকাংশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙ্ইে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম নেই। এঙ্-রে মেশিন, আলট্রা-সনোগ্রাম বা এ-জাতীয় কিছুটা দামি যন্ত্রপাতি তো নেই-ই। আবার কোথাও দেখা যায়, এঙ্-রে মেশিন আছে, কিন্তু বিকল হয়ে পড়ে আছে। এসব মেশিনে কোনো সমস্যা দেখা দিলে তা সারানোর জন্য যে দীর্ঘ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়, তা করতে করতে কয়েক বছর লেগে যায়। তত দিনে মেশিনটি সম্পূর্ণরূপে বিকল হয়ে যায়। একই অবস্থা প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষায়ও। হয় যন্ত্রপাতি বিকল, না হয় ইনগ্রেডিয়েন্ট নেই। আবার অনেক জায়গায় মেশিন আছে, ইনগ্রেডিয়েন্ট আছে; কিন্তু টেকনিশিয়ান নেই। তাই চিকিৎসকরা বাধ্য হন রোগীদের বাইরে পাঠাতে। তাঁরা জানেন, বাইরের এঙ্-রে মেশিনটি মানসম্মত নয়, প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার রিপোর্ট ঠিক পাওয়া যাবে না_কিন্তু তিনি অসহায়। অথচ চিকিৎসকদের এরই ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসাপত্র দিতে হয় এবং জেনেশুনেই দিতে হয়, এতে রোগ ভালো হওয়ার সম্ভাবনা কম। মানবিক বোধসম্পন্ন কোনো চিকিৎসকের কাছে এটি অনৈতিক বা হতাশাজনক মনে হতেই পারে। এর ফলে অনেক চিকিৎসক গ্রামে কাজ করতে আগ্রহী হন না।
কাজেই চিকিৎসকদের যেমন গ্রামমুখী হতে হবে, তেমনি সেখানকার স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোকেও মানসম্মত করতে হবে। একজন চিকিৎসকের সন্তুষ্টি নিয়ে সেখানে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.