মর্যাদা কমানোর খবর অস্বীকার সরকারের-বিভিন্ন স্থানে পলিটেকনিক ছাত্রদের সহিংসতায় আহত শতাধিক

'ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং' কোর্সের নাম বদলে 'ডিপ্লোমা ইন টেকনিশিয়ান' করে পদমর্যাদা কমানোর প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন স্থানের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনের জের ধরে গতকাল বৃহস্পতিবার বগুড়া, বরিশাল, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মাগুরা,


ময়মনসিংহ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্ররা সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। কিন্তু গতকাল রাতে এক তথ্য বিবরণীতে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের পদমর্যাদা পরিবর্তনের খবর অস্বীকার করেছে সরকার। ওই তথ্য বিবরণীতে বলা হয়েছে, সরকার ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের পদমর্যাদা পরিবর্তন করেনি এবং এ ধরনের কোনো পরিকল্পনাও সরকারের নেই। পত্রিকায় প্রকাশিত একটি ভুল তথ্যের ভিত্তিতে কয়েকটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে ও বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ করা হয়। এ ধরনের মিথ্যা সংবাদে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনুরোধ জানিয়েছে সরকার।
এদিকে বগুড়া, বরিশাল, কক্সবাজার, মাগুরা ও ময়মনসিংহে গতকাল পুলিশি বাধার কারণে পলিটেকনিকের শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং বিভিন্ন যানবাহন ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভাঙচুর করে। এ সময় বগুড়া, বরিশাল, কক্সবাজার ও মাগুরায় পুলিশ-শিক্ষার্থী সংঘর্ষে শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়। বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হওয়ারও খবর পাওয়া গেছে। পুলিশ অন্তত ৩৯ শিক্ষার্থীকে আটক করেছে। সংঘর্ষের কারণে বগুড়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আমাদের বিভিন্ন অফিস ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর :
বগুড়া অফিস জানায়, পলিটেকনিকের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে শেরপুর রোডের পলিটেকনিক এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের পদমর্যাদা দ্বিতীয় শ্রেণীতে বহাল রাখার দাবিতে সরকারি পলিটেকনিকের পাশাপাশি একটি বেসরকারি পলিটেকনিকের শিক্ষার্থীরা গতকাল রাস্তায় নেমে এলে সংঘর্ষ শুরু হয়।
প্রায় চার ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষে বগুড়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ, পুলিশের এক পরিদর্শক ও হাবিলদারসহ অর্ধশতাধিক আহত হয়েছে। পুলিশের উপর্যুপরি রাবার বুলেট নিক্ষেপের পাশাপাশি টিয়ার শেলের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে গোটা এলাকা। এ ঘটনায় বগুড়া পলিটেকনিক চার দিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সংঘর্ষের সময় পুলিশ পলিটেকনিক ক্যাম্পাসের ভেতরে ঢুকে ছাত্রদের লক্ষ্য করে টিয়ার শেল, রাবার বুলেট ও ইট ছোড়ে। এ সময় অন্তত ১০ জন ছাত্রকে আটক করে পুলিশ। পুলিশের অভিযোগ, বেসরকারি পলিটেকনিকের পরিচালক ছাত্রদের ইন্ধন দিয়ে রাস্তায় নামিয়ে দেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, গতকাল সকাল ১০টায় বগুড়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা বগুড়া-শেরপুর সড়কে নেমে আসে। এর পরই তাদের সঙ্গে যোগ দেয় ওই প্রতিষ্ঠানের বিপরীত পাশে অবস্থিত ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজি বগুড়া (আইআইটিবি) নামের বেসরকারি পলিটেকনিকের শিক্ষার্থীরা। তারা রাস্তা অবরোধ করে সমাবেশ শুরু করলে যানজট দেখা দেয়। পরে পুলিশ গিয়ে তাদের হটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সময় শিক্ষার্থীরা ব্যাপক ভাঙচুর শুরু করে। তারা পলিটেকনিক-সংলগ্ন পুলিশ লাইনের চেকপোস্ট এবং পাশের পুলিশ আবাসিক এলাকায়ও হামলা-ভাঙচুর চালায়। পরে অতিরিক্ত পুলিশ গিয়ে তাদের ওপর লাঠিচার্জ করে। একপর্যায়ে টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করা হয়। পুলিশের সঙ্গে যোগ দেন র‌্যাব সদস্যরাও। তবে শিক্ষার্থীদের ইটপাটকেল নিক্ষেপের কারণে পুলিশ ও র‌্যাব পিছু হটে। শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেয় পলিটেকনিক ক্যাম্পাসের ভেতরে। উভয় পাশ থেকেই এরপর শুরু হয় পাল্টাপাল্টি ইটপাটকেল নিক্ষেপ।
দুপুর ১টার দিকে বগুড়ার জেলা প্রশাসক (ডিসি) সারোয়ার মাহমুদ ও পুলিশ সুপার (এসপি) মোজাম্মেল হক ঘটনাস্থলে গিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। শিক্ষার্থীরা জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলতে সম্মত হলেও পুলিশ সুপারকে ভেতরে ঢুকতে বাধা দেয়। পুলিশ সুপার বের হয়ে যাওয়ার পরপর আবারও ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু হয়। বাধ্য হয়ে জেলা প্রশাসক সেখান থেকে ফিরে যান। এসপি ও ডিসি ফিরে যাওয়ার পরপরই মারমুখী হয়ে ওঠে পুলিশ ও র‌্যাব। তারা টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করতে করতে ক্যাম্পাসের ভেতর ঢুকে যায়। পুলিশ-র‌্যাবের তাড়া খেয়ে শিক্ষার্থীরা আশ্রয় নেয় পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শ্রেণীকক্ষ, আবাসিক হল ও মসজিদে। পুলিশ মসজিদের ভেতরে ঢুকেও ছাত্রদের বেধড়ক পেটায়।
বরিশাল অফিস জানায়, পদাবনমনের প্রতিবাদে বরিশাল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা নগরীতে তাণ্ডব চালিয়েছে। গতকাল দুপুর আড়াইটায় শিক্ষার্থীরা ইনস্টিটিউট থেকে লাঠিসোঁটাসহ বিক্ষোভ মিছিল বের করে। নগরীর বটতলা এলাকায় পুলিশ বাধা দিলে দুই পক্ষের মধ্যে কথাকাটাকাটি হয়। এ সময় পুলিশ এক শিক্ষার্থীকে আটক করলে অন্য শিক্ষার্থীরা তাকে ছিনিয়ে নেয় এবং কোতোয়ালি মডেল থানার এসআই আলমগীর হোসেনকে মারধর করে। এরপর তারা ইটপাটকেল ও লাঠিসোঁটা নিয়ে বটতলা এলাকা থেকে সামনে যা পেয়েছে তা-ই ভাঙচুর করতে করতে হাতেম আলী কলেজ চৌমাথা সিঅ্যান্ডবি সড়কে অবস্থান নেয়। ওই ঘটনায় বটতলা বাজার এলাকার বেশ কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা বটতলা বাজার এলাকায় ম্যাজিক কম্পানির তিনটি গাড়ি, মিল্ক ভিটার পিকআপ, আলফা টেম্পো ও একটি প্রাইভেট কার ভাঙচুর করে এবং শাইনপুকুর ও ওয়ালটনের একটি করে শোরুমে হামলা চালায়। এ ছাড়া তারা জয়ফিয়া প্লাজায় ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে।
বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা এরপর নগরীর হাতেম আলী কলেজ চৌমাথা অবরোধ এবং টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করে। সেখানে তারা যাত্রীবাহী বাস, পণ্যবাহী ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহনে হামলা চালায়। এতে ঢাকা থেকে আসা সাকুরা পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাসের অন্তত ৫০ যাত্রী কমবেশি আহত হয়।
চট্টগ্রাম অফিস জানায়, পদমর্যাদার অবনমনের প্রতিবাদে গতকালও চট্টগ্রাম ন্যাশনাল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের কয়েক শ শিক্ষার্থী বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে। ক্লাসরুমে তালা ঝুলিয়ে ও ক্লাস বর্জন করে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা সড়কে নামে। দুপুর ১২টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা রাজপথে ছিল। সে সময় তারা নগরীর মুরাদপুর এলাকায় বেশ কয়েকটি রিকশা উল্টে দেয় এবং প্রবর্তক মোড়ে একটি প্রাইভেট কার ভাঙচুর করে। মিছিলের আগে-পরে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা ছিল।
কক্সবাজার অফিস জানায়, কক্সবাজার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা গতকাল কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সকাল ১০টা থেকে প্রায় তিন ঘণ্টা অবরোধ করে রাখে এবং ১০টি গাড়ি ভাঙচুর করে। সে সময় পুলিশ-শিক্ষার্থী সংঘর্ষে ৩০ জন আহত হয়। পুলিশ ফাঁকা গুলি ও টিয়ার শেল ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ঘটনাস্থল থেকে পাঁচ শিক্ষার্থীকে আটক করেছে পুলিশ। শিক্ষার্থীরা দাবি করেছে, পুলিশের গুলিতে দুই ছাত্র গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তবে এর সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
মাগুরা প্রতিনিধি জানান, মাগুরা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্ররা গতকাল সকালে মাগুরা-ঝিনাইদহ মহাসড়ক অবরোধ করে। বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা বেশ কয়েকটি যানবাহনে ভাঙচুর চালালে পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এতে কয়েকজন বাসযাত্রীসহ ছাত্র ও পুলিশ মিলে ১০ জন আহত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ৯টি শটগানের গুলি ছোড়ে ও ১৫টি টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে।
ময়মনসিংহ থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, ময়মনসিংহ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা গতকাল দুপুরে বিক্ষোভ মিছিল করে। সে সময় তারা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক প্রায় আধা ঘণ্টা অবরোধ করে রাখে ও কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে। গাড়ি ভাঙতে গেলে এলাকাবাসীর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়। পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর আন্দোলনকারীরা ক্যাম্পাসে ফিরে গেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি জানান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা গতকাল সকালে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করে। ফলে সকাল ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত ওই সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ড. আশরাফুল আলম ও ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ মো. মহসিনুর রহমান আলোচনার আশ্বাস দিলে শিক্ষার্থীরা অবরোধ তুলে নেয়।

No comments

Powered by Blogger.