বাঙালির কবি জগতের ছবি by করুণাময় গোস্বামী

১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর রবিবার বিকেলে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বিপুল সমারোহে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সে এক আশ্চর্য ঘটনা। ১৮৯৯ সালে যে কবির জন্ম এবং বলতে গেলে ১৯২০ সালের পর যিনি কবি হিসেবে বাংলা সাহিত্যমঞ্চে আবির্ভূত, ১৯২৯ সালে


এসেই তাঁর জাতীয় সংবর্ধনা বিস্ময়কর লাগে এ জন্য যে কত দ্রুত কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালির জাতীয় মানসকে এমন প্রবলভাবে অধিকার করে বসেন যে তারা তাঁকে শুধু গ্রহণ করেই ক্ষান্ত হয়নি, জাতীয় কবি হিসেবে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে তারা তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করে নিতে চাইল। সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রফুল্লচন্দ্র রায়। মানপত্র পাঠ করেন জাতীয় সংবর্ধনা কমিটির সভাপতি এস ওয়াজেদ আলী। মানপত্রে তিনি বলেন, 'কবি তোমার অসাধারণ প্রতিভার অপূর্ব অবদানে বাঙালিকে চিরঋণী করিয়াছ। তুমি তাহাদের কৃতজ্ঞতাসিক্ত, সশ্রদ্ধ অভিনন্দন গ্রহণ করো।
তোমার কবিতা বিচার বিস্ময়ের উর্ধ্বে, সে আপনার পথ রচনা করিয়া চলিয়াছে পাগলা ঝোরার জলধারার মতো। সে স্রোতধারায় বাঙালি যুগসম্ভাবনার বিচিত্র লীলা বিশ্ব দেখিয়াছে। আজ তুমি তাহাদের বিস্ময়বিমুগ্ধ কণ্ঠে অভিনন্দন লও।
বাংলার মানুষ কাব্যকণ্ঠ তোমার প্রাণের রঙে সবুজ মহিমায় রাঙ্গিয়া উঠিয়াছে। তাহার ছাড়া বাঙালির পলকহারা নীল নয়নে নিবিড় স্নেহ অঞ্জন মাখাইয়া দিয়াছে। আজ তুমি তাহাদের মুগ্ধ নয়নের নির্বাক বন্দনা গ্রহণ করো। তুমিই বাঙালির ক্ষীণ কণ্ঠে তেজ দিয়াছ, মূর্ছাতুর প্রাণে অমৃতধারা সিঞ্চন করিয়াছ। আজ অরুণ ঊষার তোরণদ্বারে দাঁড়াইয়া তাহারা তোমার মরণ- জিগীষু কণ্ঠে জয় ইঙ্গিত নত মস্তকে চয়ন করিতেছে। তাহাদের হাতের পতাকা তোমার মহিমার উদ্দেশে অবনমিত হইয়াছে। জাতির এ অভিবাদনে তুমি নয়নপাত করো।
তুমি বাঙলার মধুবনেরও শ্যামা কোয়েলার কণ্ঠে ইরানের গুলবাগিচার বুলবুলের বুলি দিয়াছ, রসালের কণ্ঠে সহকার শাখে আঙ্গুর লতিকার বাহুবন্ধন রচনা করিয়াছ। তুমি বাঙালির শ্যাম শান্ত কণ্ঠে ইরানী সাকির লাল সিরাজির আবেশ বিহ্বলতা দান করিয়াছ। আজ তোমার আসন প্রান্তে হাতের বাঁশি রাখিয়া তাহারা তোমারই সম্মুখে দাঁড়াইয়াছে। তুমি তাহাদের শ্রদ্ধা সুন্দর চিত্ত বিনোদন গ্রহণ করো।
ধুলার আসনে বসিয়া মাটির মানুষের গান গাহিয়াছ তুমি। সে গান অনাগত ভবিষ্যতের। তোমারই নয়ন সায়রে তাহার ছায়াপাত হইয়াছে। মানুষের ব্যথা বিষে নীল হইয়া সে তোমার কণ্ঠে দেখা দিয়াছে। ভবিষ্যতের ঋষি তুমি, চিরঞ্জীব মনীষী তুমি, তোমাকে আজ আমাদের সবাকার মানুষের নমস্কার।'
এই অসাধারণ মানপত্রে এস ওয়াজেদ আলী নজরুলের সাহিত্য-সংগীত সুকৃতির মর্মবাণী তুলে ধরলেন। আমি বিশেষ করে দৃষ্টি আকর্ষণ করব এই বিষয়টিতে গিয়ে ওয়াজেদ আলী বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে প্রদত্ত সংবর্ধনা সভায় দাঁড়িয়েও নজরুলকে শুধু বাঙালির পক্ষ থেকেই নমস্কার জানাননি, সব মানুষের পক্ষ থেকে নমস্কার জানিয়েছেন। এই মানুষের কোনো দেশ-কাল-পাত্র বিচার নেই, এরা সব কালের সব স্থানের মানুষ।
এই মানপত্রের প্রত্যুত্তরে নজরুল একটি প্রতিভাষণ দান করেন। নজরুল বলেন, 'বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে আমি জন্মগ্রহণ করেছি। এরই অভিযান সেনাদলের তূর্যবাদকের একজন আমি, এই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়। আমি জানি, এই পথযাত্রার পাকে পাকে বাঁকে বাঁকে কুটিল ফণাভুজঙ্গ প্রখর দর্শন শার্দূল পশুরাজের ভ্রুকুটি। এবং তাদের নখর দংশনের ক্ষত আজো আমার অঙ্গে অঙ্গে। তবু ওই আমার পথ, ওই আমার গতি, ওই আমার ধ্রুব। ... আকাশের পাখিকে, বনের ফুলকে, গানের কবিকে, তারা যেন সকলের তরে দেখেন। আমি এই দেশের এই সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু এই দেশেরই এই সমাজেরই নই। আমি সকল দেশের সকল মানুষের। সুন্দরের ধ্যান তার স্তবগানই আমার বাসনা, আমি ধন্য যে কুলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই আমি জন্মগ্রহণ করি সে আমার দৈব, আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই কবি।'
এই প্রতিভাষণের এক জায়গায় নজরুল বলেন, 'একথা স্বীকার করতে আজ আমার লজ্জা নেই যে আমি শক্তিসুন্দর রূপসুন্দরকে ছাড়িয়ে আজো উঠতে পারিনি। সুন্দরের ধ্যানী দুলাল কীটসের মতো আমারও মন্ত্র বিউটি ইজ ট্রুথ ট্রুথ ইজ বিউটি।'
যথার্থ কবির মতো, বড় মাপের কবির মতো, সারা পৃথিবীর মানুষ নিয়ে ভাবেন, এমন কবির মতো কথা বললেন নজরুল। সত্যি তো কবি একটি দেশে, সমাজে ও ধর্মে জন্মগ্রহণ করেন, তাঁর নিজের ভাষায় লেখেন, কিন্তু তিনি যদি বড় কবি হন, যদি তাঁর ভাবনায় থাকে বিশ্বমানব, তাহলে তিনি শুধু তাঁর নিজের দেশের বা নিজের ভাষার কবি হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকেন না। নজরুল তাই মাত্র ৩০ বছর বয়সে প্রদত্ত জাতীয় সংবর্ধনায় স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলেন, তিনি বাঙালির কবি বটে, তিনি বিশ্ব মানুষেরও কবি। তিনি বাংলায় জন্মেছেন, বাংলা ভাষায় লিখছেন, বাঙালির জীবন সমস্যাকে তুলে এনেছেন তাঁর লেখায়; তাই বাঙালি সমাজ তাঁকে নিজেদের কবি বলে ভাবছে। সে সত্যি নিশ্চয়ই বাঙালি তো তাঁকে নিজেদের কবি বলে ভাববেই। কিন্তু স্মরণ রাখতে হবে, নজরুল জগতের সব মানুষের জন্যই ভাবছেন। বাংলা ভাষায় লিখছেন বলে তিনি সব মানুষের কাছে পৌঁছছেন না; কিন্তু তাঁর অন্তরে যে বেদনা, ভাবনায় যে বিদ্রোহ তা সব মানুষের জন্যই।
আমরা বিদ্রোহী কবিতার কথাই যদি ধরি, তাহলে ভাবতে কষ্ট হয় না তিনি যে মাথা তুলে দাঁড়ানোর আহ্বান জানালেন, বললেন : বল বীর/বল উন্নত মম শির/শির নেহারি আমারি/নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির, সেটা শুধু বাঙালি সমাজকে নির্ভীক করে তোলার জন্য নয়, ঔপনিবেশিক শাসনের ভারে পিষ্ট জগতের সব মানুষকে জেগে ওঠার আহ্বান জানালেন তিনি। যেন কেউ নিজেকে দুর্বল মনে করে ঔপনিবেশিকতাকে স্বীকার করে না নেন। যেন ভাবেন সংসারে কেউ দুর্বল নয়, জগতে কেউ অত্যাচারিত হয়ে থাকার জন্য জন্মায়নি। সবারই অধিকার আছে, শক্তি আছে মাথা তুলে দাঁড়ানোর। আর সবাই যদি একবার মাথা তুলে দাঁড়ায়, তাহলে হিমালয় নতশির হয়ে পড়বে। অথবা কোনো বাধাই মানুষের জয়কে ঠেকাতে পারবে না। অত্যাচারিত সমাজে বীরত্বের জাগরণ প্রয়োজন, সে সমাজ বাংলায় হতে পারে, এশিয়ায় হতে পারে, আফ্রিকায় হতে পারে। কবি বলছেন, সবার জন্য। কিন্তু বাংলা ভাষায় বলছেন বলে বাঙালির বোধগম্য হয়ে উঠছে। যদি তিনি আফ্রিকার কোনো দেশে জন্মাতেন, সে দেশের ভাষায় লিখতেন, তাহলে সে দেশের মানুষের বোধ্য ও আদরণীয় হয়ে উঠতেন। বিদ্রোহী কবিতার শেষের দিকে গিয়ে কবি বললেন, 'মহা বিদ্রোহী রণক্লান্ত/আমি সেই দিন হবো শান্ত/যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল/আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না/অত্যাচারীর খৰকৃপাণ/ভীম রণভূমে রণিবে না, তখন কিন্তু তিনি বাংলা বা ভারতবর্ষের কথা মাত্র বললেন না। এখানে তিনি বিশ্বজগতের কথা বললেন। ঔপনিবেশিক বিশ্বজুড়ে উৎপীড়িত মানুষের যে ক্রন্দন রোল উঠছে, অত্যাচারীর যাবতীয় দমনচেষ্টা ভয়ংকর থেকে ভয়ংকর হয়ে উঠছে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট গণ্ডি নেই। বিদ্রোহী নজরুলের এই যে লক্ষ্য, তিনি অত্যাচারীর অবসান চান, এটা কোনো দেশকালে সীমাবদ্ধ বিষয় নয়। ফরিয়াদ কবিতায় তিনি যখন বলছেন : এই ধরণীর ধূলিমাখা তব অসহায় সন্তান/মাগে প্রতিকার/উত্তর দাও আদি পিতা ভগবান, তখন কিন্তু তিনি ধরণির কথা বললেন, শুধু বাঙালির কথা বললেন না, বাংলাও ধরণির মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত।
নজরুলের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে মানুষ স্বাধীন থাকবে, মানুষ শোষণমুক্ত থাকবে, নারী তার অধিকার পাবে, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা তার অধিকার পাবে, সমাজ বিবেচনার মূল বিষয় হবে প্রগতি। এ ধারণা কোনো স্থানে-কালে সীমাবদ্ধ বিষয় নয়। মানুষের সামাজিক মুক্তি চিরন্তন, বিশ্বজনীন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-শৈল্পিক আদর্শকে সামনে রেখে তিনি কাজ করেছেন। সে কাজ করার জন্য কষ্ট স্বীকার করেছেন, জেলজুলুম পর্যন্ত এগিয়েছে ব্যাপারটা। কিন্তু নজরুল কখনো দমে যাননি। তিনি কী আদর্শ নিয়ে কবি হিসেবে জীবন শুরু করেছিলেন এবং সারা জীবন কী আদর্শে অবিচল ছিলেন, সে কথা বহু প্রসঙ্গে বহুবার তিনি জানিয়েছেন। সব কথার সার হচ্ছে তিনি বিশ্বসমাজকে অভেদসুন্দর সাম্যের আদর্শে উদ্বোধিত করতে চেয়েছেন। আজকের পৃথিবীতে এ আকাঙ্ক্ষা যে কত প্রাসঙ্গিক, মুক্তির বিষয়টি যে কত বড়, সে আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারি। নজরুলের মহত্বের এ ব্যাপকতাকে আমরা আজও যথার্থভাবে বিশ্বসমাজে পৌঁছে দিতে পারিনি। কেমন করে পৌঁছে দেওয়া যায় আমাদের নিত্যনিয়ত চেষ্টার মধ্যে থাকা প্রয়োজন, যেন সবাই জানে তিনি বাঙালির কবি বটে; কিন্তু তিনি জগতের কবি।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক

No comments

Powered by Blogger.