সমাজ-চোখ ভিজে যায় চোখের জলে by ফজলুল হালিম রানা

প্রথমেই বলে নিই, শিরোনামটি আমার লেখা একটি কবিতার প্রথম লাইন। সারারাত ভেবেও অন্য কোনো শিরোনাম দাঁড় করানো গেল না বলে দুঃখিত। আগেই ক্ষমা চেয়ে নিলাম। কারণ পাঠককে আবেগতাড়িত করা আমার কাজ নয়।
যাই হোক, মূল প্রসঙ্গে আসি।


একজন মায়ের কথা বলছি, বলছি একজন বোনের কথা, একজন স্ত্রীর কথা, একজন শিক্ষিকার কথা কিংবা একজন মেধাবী তরুণীর কথা, যিনি ৫ জুন রাজধানীর ধানমণ্ডিতে বাবার বাড়িতে স্বামী হাসান সাইদের হাতে নির্মমভাবে নির্যাতিত হন। 'কক্ষে ঢুকেই পেছন থেকে হামলা চালায় ও। চুলের মুঠি ধরে দুই চোখে আঙুল ঢুকিয়ে দেয়। কামড়ে নাক-মুখ ক্ষতবিক্ষত করে। রক্তে পুরো শরীর ভরে যায়। এক পর্যায়ে মেঝেতে পিছলে পড়ি নিজের রক্তের ওপর। এরপর... জ্ঞান ফিরলে দেখি, হাসপাতালের বিছানায়' (প্রথম আলো, ১৪ জুন)_ কথাগুলো রুমানা মনজুরের। তিনি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। এ গেল রুমানার একদিনের বর্ণনা, যা তিনি হাসপাতালে বসে জানালেন। কিন্তু এ রকম ঘটনা তিনি হজম করেছেন গত ১০টি বছর। পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে আনুষা এবং বাঙালি নারী হিসেবে তার ঘরের টানেই শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন স্বামীর সব অন্যায় মেনে নিয়েও ঘর করার। রুমানার বাবা অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মনজুর হোসেন মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। তিনি বলেন, 'আমার মেয়েটা খুব নম্র স্বভাবের। ১০ বছর ধরে সংসার করছে, আমাদের কখনও স্বামীর নির্যাতনের বিষয়ে কিছু বলেনি' (প্রথম আলো, ১৪ জুন)। পারিবারিক এ নির্যাতনের খবর সভ্য সমাজকে চরমভাবে নাড়া দিয়েছে। রুমানা মনজুর এসএসসি, এইচএসসি_ দুটোতেই স্টার মার্কস পেয়েছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় দুটোতেই ফার্স্ট হয়েছেন। এরপর শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। রুমানা ২০১০ সালের ১ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক বছরের শিক্ষা ছুটি নিয়ে কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় মাস্টার্স করার জন্য যান। চলতি বছরের ১ আগস্ট তার শিক্ষা ছুটি শেষ হওয়ার কথা। রুমানার বিদেশ যাওয়ার ঘোর বিরোধী ছিলেন তার স্বামী হাসান সাইদ। রুমানা দেশে আসার পর থেকে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এ নিয়ে প্রায়ই ঝগড়া হতো। এরই এক পর্যায়ে ৫ জুন ছোট্ট ফুটফুটে পাঁচ বছরের শিশু আনুষার সামনেই নির্মমভাবে নির্যাতন চালানো হয় রুমানার ওপর। আনুষা তার মাকে নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছে। অনেক অনুনয়-বিনয়, কান্নাকাটি, চিৎকার-চেঁচামেচি করেছে সে। কোনো কিছুতেই পিতার হৃদয় গলাতে পারেনি আনুষা। বাবা যদি হয় লম্পট, ছোট্ট ফুটফুটে আনুষা আর কীই-বা করতে পারে? রুমানার নাকের বাঁ পাশের অংশ কামড়ে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। নাক, মুখ, কানসহ শরীরের অনেক জায়গায় মাংস ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। হায়রে স্বামী! রুমানা এখন হাসপাতালে। তার বাঁ চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। ডান চোখ দিয়েও তিনি আর কোনোদিন দেখবেন কি-না তা পুরোটাই অনিশ্চিত। রুমানার যে চোখ বিশ্ববিদ্যালয়কে আলোকিত করেছে, যে চোখ রাষ্ট্রকে আলোকিত করেছে, আলোকিত করেছে বিশ্বকে, সেই চোখ আর আলো ছড়াবে না, পড়ে থাকবে অন্ধকারে। কী নির্মম! রুমানা একজন মা, একজন গৃহিণী, একজন শিক্ষিকা, একজন বোন, একজন অভিভাবক। বিশ্ববিদ্যালয়েই তার রয়েছে হাজারো সন্তান। তারা তার ওপর নির্যাতনের বদলা নেবে। সভ্য সমাজের সব বিবেকবান মানুষই হাসান সাইদের বিচার চাইবে_ এটিই স্বাভাবিক। আমিও চাই, শুধু হাসান সাইদের নয়, পুরুষ প্রভাবিত এ দেশের সব হাসান সাইদের বিচার হোক, যারা প্রতি রাতেই রুমানাদের অন্ধ করে দেয়, যারা নিজেদের অক্ষমতা বা ব্যর্থতাকে নিজের স্ত্রীর ওপর চাপিয়ে তার শরীরের ওপর প্রতিশোধ নেয়। বিচার চাই ওই হাসান সাইদদেরও, যারা নিজেকে নারীবাদী দাবি করে গলায় প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে সকালে অমর একুশে কিংবা অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে উপস্থিত হয় আবার ফিরে এসে রাতে নারীকে তোষণ করে। এ দেশের পুরুষদের মানসিকতা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে? রুমানা তো এ দেশের সাধারণ কোনো গৃহিণী নন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তার যদি এ অবস্থা হয় তাহলে এ দেশের খেটে খাওয়া রুমানারা যাদের কপালে থাকে শ্রমের চিটচিটে ঘাম কিংবা যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় তাদের যে কী অবস্থা তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মাফ করবেন রুমানা ম্যাডাম, আমরা আপনাকে অপমান করেছি, ছোট করেছি, আপনি মানুষ গড়ার কারিগর। আপনার চোখ দেখে আজ চোখ ভিজে যায় চোখের জলে। আপনার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। আর আনুষা, তোমাকে আমাদের দেওয়ার কথা ছিল একমুঠো স্বপ্ন। আমরা (পুরুষরা!) তা দিতে পারলাম না। দিয়েছি একমুঠো অভিমান। তুমি আমাদের ক্ষমা করে দিও।

ফজলুল হালিম রানা : প্রভাষক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, জাবি

No comments

Powered by Blogger.