আদমশুমারিতে সব আদিবাসী জাতির তথ্য সংগ্রহ করা দরকার by শক্তিপদ ত্রিপুরা

কয়েক দিনের মধ্যে সরকার আদমশুমারির কাজ শুরু করতে চলেছে। শুমারির ফরমেটে তথ্য সংগ্রহের জন্য ২৭ আদিবাসীর নাম উল্লেখ আছে। তার অর্থ হলো, এ শুমারি হওয়ার পর ২৭ আদিবাসী জাতির জনসংখ্যা, শিক্ষার হার ইত্যাদি তথ্য পৃথকভাবে জানা যাবে। তবে বাকি আদিবাসী জাতির জনসংখ্যা কত,


তাদের শিক্ষার হার ও অন্যান্য তথ্য পৃথকভাবে জানার সুযোগ থাকবে না। কারণ ২৭ আদিবাসী জাতি ছাড়া বাকি আদিবাসী বা অন্যান্য জাতি বা সম্প্রদায়ের তথ্য সংগ্রহের জন্য পৃথকভাবে নয়, 'অন্যান্য' নামে একটি মাত্র কলাম রাখা হয়েছে। অন্যান্য জাতির নামে তাদের সবার তথ্য সংগ্রহ করা হবে। অর্থাৎ উলি্লখিত আদিবাসী ব্যতীত অপরাপর আদিবাসী জাতির জনসংখ্যার পরিমাণ, শিক্ষার হার ইত্যাদি তথ্য পৃথকভাবে পাওয়া যাবে না; 'অন্যান্য জাতি নামে' তাদের তথ্যাবলি সমষ্টিগতভাবে পাওয়া যাবে। একটি দেশের জন্য, জাতির জন্য সঠিক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের প্রশ্নে সঠিক তথ্য-উপাত্ত একটি অত্যাবশ্যকীয় জরুরি বিষয়। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার জানে না, দেশে কয়টি আদিবাসী জাতি আছে? তাদের জনসংখ্যা কত? সরকার যদি তাদের জনসংখ্যা, অর্থনৈতিক অবস্থা, সামাজিক অবস্থা, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের অবস্থা, তাদের আয়ের উৎস, চিকিৎসা সুবিধা-অসুবিধা, পানীয় জল ও স্যানিটেশন, তাদের ভাষা-সংস্কৃতির অবস্থা না জানে, তাহলে কিভাবে এদের জন্য উন্নয়ন পরিকল্পনা করবে?
সরকারের হিসাবমতে, এ দেশে আদিবাসী জাতির সংখ্যা ২৭। আদিবাসীবিষয়ক সরকারের সর্বশেষ আইন_'ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০'-এ উল্লেখ আছে এ দেশে আদিবাসী জাতির সংখ্যা ২৭। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের হিসাবমতে এ দেশে ৪৬-এর অধিক আদিবাসী জাতি বাস করে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন হওয়ার পর আদিবাসী সংগঠন ও নেতারা এবং আদিবাসী বিশেষজ্ঞ কর্তৃক আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়েছে যে বাংলাদেশে আদিবাসী জাতির সংখ্যা ২৭ নয়, ৪৬-এর অধিক। এ সংখ্যা ষাট বা সত্তরও হতে পারে। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখিও হয়েছে। এর পরও এই গণতান্ত্রিক সরকার, ভোট বিপ্লবের সরকার এ আদিবাসীদের প্রিয় দল ও প্রিয় সরকার আদিবাসীদের কান্না শুনতে পেল না_এর চেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনা আর কী হতে পারে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলের সরকার যদি আদিবাসীদের এভাবে উপেক্ষা করে, তাহলে আদিবাসীরা যাবে কোথায়? যদি তা-ই হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কী হবে? নির্বাচনী ইশতেহারের অঙ্গীকারের কী হবে?
আমরা সরকারের কাছে আবেদন করছি, দাবি জানাচ্ছি, যাতে সরকার ২০১১ সালের আদমশুমারিতে সব আদিবাসী জাতিকে অন্তর্ভুক্ত করে, যাতে এ শুমারির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে কয়টি আদিবাসী জাতি আছে, তাদের জনসংখ্যা, শিক্ষার হার ও অন্যান্য তথ্য জানা যেতে পারে। এটি আদিবাসীদের জন্য যত না জরুরি, তার চেয়ে অধিক জরুরি এ সরকারের জন্য। সরকার অঙ্গীকার করেছে, দেশের পিছিয়ে পড়া আদিবাসী জাতিগুলোর শিক্ষা ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিশেষ বরাদ্দ ও বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সরকার যদি পিছিয়ে পড়া আদিবাসী জাতিগুলোর উন্নয়নের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চায়, তাহলে এ ক্ষেত্রে প্রথম জরুরি কাজটি হলো_তাদের বর্তমান অবস্থার বিষয়ে সার্বিক ও সঠিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা। তথ্য-উপাত্ত ছাড়া কোনো জাতি বা দেশের উন্নয়ন কল্পনাই করা যায় না। আশা করি, সরকার আদিবাসীদের তাদের এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে না। সরকার তার দায়িত্বের প্রতি অবহেলা করবে না। তজ্জন্য সরকার সব আদিবাসী জাতির নাম উল্লেখ করে ফরমেট ছাপিয়ে সব আদিবাসী জাতির তথ্য সংগ্রহ করতে পারে অথবা 'অন্যান্য' নামে যে কলামটি রয়েছে, ফরম পূরণ করার সময় যে জাতির সদস্যের তথ্য সংগ্রহ করা হবে সে জাতির নাম উল্লেখ করেও এবারের শুমারিতে সব আদিবাসী জাতির সংখ্যা, আলাদাভাবে প্রতিটি আদিবাসী জাতির শিক্ষা ও অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। আদিবাসী গ্রামগুলোর বেশির ভাগ পাহাড়-পর্বত ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত। এসব অঞ্চলে আদিবাসী তথ্য সংগ্রহকারী নিয়োগ করা না হলে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়বে। অতীতে দেখা গেছে, শুমারির কাজে নিয়োজিত তথ্য সংগ্রহকারীরা বাড়িতে বসে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। কারণ, পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে কোনো অ-আদিবাসীর পক্ষে তথ্য সংগ্রহ করা কঠিন ব্যাপার। যে কারণে অতীতের শুমারিগুলোতে সঠিক তথ্য সনি্নবেশিত হয়নি। তাই আদিবাসীদের সঠিত তথ্য পাওয়ার জন্য আদিবাসী এলাকায় আদিবাসী নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে আদিবাসী তথ্য সংগ্রহকারী নিয়োগ প্রদান করা অত্যাবশ্যক।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইনে দুটি সমস্যা রয়ে গেছে। এই আইনে বাংলাদেশে মাত্র ২৭টি আদিবাসী জাতিকে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। অপরদিকে এই আইনে আদিবাসীদের আখ্যায়িত করা হয়েছে 'ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী' হিসেবে। ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী বা বৃহৎ জনগোষ্ঠী_এটি কোনো জাতির নাম হতে পারে না। এ দেশের আদিবাসীদের প্রত্যেকের নাম রয়েছে। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, সাঁওতাল, খাসিয়া, হাজং, মাহাতো ইত্যাদি। এদের সমষ্টিগত নাম 'আদিবাসী'। সুতরাং আদিবাসীদের ক্ষেত্রেও তাদের নিজেদের নামে আইন হবে না কেন? সমষ্টিগতভাবে তাদের আদিবাসী বলা হবে না কেন? ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন-২০১০ হওয়ার আগে এ দেশের সমাজবিজ্ঞানীরা অভিমত প্রকাশ করেছিলেন যে 'ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী' নামে কোনো জনগোষ্ঠীর নাম হতে পারে না।
এটি বাস্তব যে সব আদিবাসীর নাম উল্লেখপূর্বক নতুন ফরমেট ছাপিয়ে শুমারি করা সরকারের পক্ষে এখন আর সম্ভব নাও হতে পারে। কারণ, সময় অত্যন্ত কম। তবে সরকার এই ফরমেটের মধ্য দিয়েও সব আদিবাসীর জনসংখ্যাসহ যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব। দেশে কয়টি আদিবাসী জাতি আছে এবং পৃথকভাবে তাদের জনসংখ্যা নির্ণয় করা সম্ভব। শুমারির ফরমেটে 'অন্যান্য' নামে যে কলামটি রয়েছে, সে কলামে যে জাতির সদস্যের তথ্য সংগ্রহ করা হবে সে জাতির নাম লিপিবদ্ধ করলে দেশের সব জাতির নাম, তাদের আলাদা জনসংখ্যা ও অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব। আমাদের প্রত্যাশা, সরকার বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

লেখক : রাজনীতিক ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.