নজরুল জাতীয় কবি শুধু মুখেই-রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নেই, কোনো গেজেটও হয়নি by আজিজুল পারভেজ

বাংলাদেশের জাতীয় বৃক্ষ কী- এ প্রশ্নের উত্তর অনেকেই হয়তো বলতে পারবেন না। কিন্তু বাংলাদেশের জাতীয় কবি কে- এ প্রশ্নের উত্তর না-জানা মানুষ এ দেশে খুব কমই আছে। সবাই চট করে বলে দিতে পারে, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। অথচ বিস্ময়কর ব্যাপার হলো,


কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদায় অভিষিক্ত করা হলেও বিষয়টির আনুষ্ঠানিক কোনো ভিত্তি দেওয়া হয়নি। তিনি জাতীয় কবি হয়ে আছেন শুধুই মুখে মুখে। এর কোনো রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত কখনো ঘোষিত হয়নি, রাষ্ট্রীয় কোনো গেজেটও কখনো প্রকাশিত হয়নি। বিষয়টি শুধু বড় রকমের একটি 'জাতীয় ভুল'ই নয়, জাতীয় কবি নজরুলের জন্যও 'অবমাননাকর' বলে অনেকের মন্তব্য।
অথচ কোনো বিষয়কে 'জাতীয়' হিসেবে ঘোষণার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানা গেছে, রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট বিভাগ কিংবা সরকারের মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব গেলে তা মন্ত্রিপরিষদের সভায় অনুমোদনের পর গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। এই প্রক্রিয়ায় এর আগে শাপলাকে জাতীয় ফুল, দোয়েলকে জাতীয় পাখি, রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে জাতীয় পশু, ইলিশকে জাতীয় মাছ ইত্যাদি ঘোষণা করা হয়। আর জাতীয় সংগীতের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি তো সংবিধানেই আছে। সর্বশেষ জাতীয় বৃক্ষ হিসেবে আমগাছও স্বীকৃতি পেয়েছে আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়াতেই। কিন্তু জাতীয় কবির বেলায়ই রয়ে গেছে অসম্পূর্ণতা।
বিষয়টি স্বীকার করেছেন নজরুল ইনস্টিটিউটের পরিচালক বিশিষ্ট লেখক রশীদ হায়দার। তবে তিনি বলেছেন, যে কবিকে এ দেশের মানুষ অন্তরে গ্রহণ করছে, ধারণ করছে, লালন করছে- তাঁর জন্য আনুষ্ঠানিক ঘোষণার প্রয়োজন আছে কি? তিনি বলেন, জাতীয় কবি হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকী রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতায় পালন করা হয়। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতাও নজরুলকে জাতীয় কবি উল্লেখ করে তাঁর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে বাণী প্রদান করেন। রশীদ হায়দার বলেন, 'এরপর আর আনুষ্ঠানিক ঘোষণার প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না।'
নজরুল ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক আবদুল হাই সিকদারও নিশ্চিত করে বলেছেন, নজরুলকে জাতীয় কবি ঘোষণা করে কোনো গেজেট হয়নি। তিনি বলেন, 'নজরুল আমাদের জাতীয় কবি- এটা মুখে মুখেই চলে আসছে।' নজরুলকে জাতীয় কবি ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করা উচিত বলে তিনি মনে করেন। তিনি আরো বলেন, কোনো কারণে ভুল হয়ে গেলে ভুল ধরা পড়ার পরপরই তা সংশোধন হওয়া উচিত।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলার জাতীয় কবি হিসেবে প্রথম অভিহিত করা হয় ১৯২৯ সালে। তখন কবির বয়স ছিল মাত্র ৩০ বছর। ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতার অ্যালবার্ট হলে জাতির পক্ষ থেকে নজরুলকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। সে অনুষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় আর প্রধান অতিথি ছিলেন নেতাজি সুভাসচন্দ্র বসু। সে সভায় কাজী নজরুল ইসলামকে 'বাংলার জাতীয় কবি' ঘোষণা করা হয়।
বাংলা সাহিত্যে আলোড়ন সৃষ্টিকারী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪২ সালে তিনি অসুস্থ ও বাকহারা হয়ে পড়েন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কাজী নজরুল ইসলামকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। তাঁর গান 'চল চল চল'কে রাষ্ট্রীয়ভাবে রণসংগীত হিসেবে গ্রহণ করা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে ধানমণ্ডিতে একটি বাড়ি দেওয়া হয়।
এরপর জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৬ সালে নজরুলকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দিয়ে রাষ্ট্রীয় একুশে পদক প্রদান করা হয়। সে বছরের ২৯ আগস্ট কবি মারা গেলে তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। ১৯৮২ সালে এইচ এম এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর নজরুলের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন শুরু হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নজরুল গবেষক জানান, নজরুল জন্মজয়ন্তীর একটি অনুষ্ঠানে এরশাদ প্রথম উল্লেখ করেছিলেন, 'বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি।' এরশাদের শাসনামলে ১৯৯৪ সালে ধানমণ্ডির 'কবি ভবন'-এ নজরুল বিষয়ে গবেষণার জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নজরুল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেখানে নজরুল জাদুঘরও করা হয়েছে।
এর বাইরে বাংলাদেশে নজরুল স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সরকারিভাবে। এগুলো রয়েছে ময়মনসিংহের ত্রিশাল ও দরিরামপুর এবং কুমিল্লায়। চট্টগ্রামেও নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র হচ্ছে। ত্রিশালে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য 'নজরুল চেয়ার' রয়েছে।
জাতীয় কবি হিসেবে নজরুলের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না থাকার বিষয়টি জাতির জন্য অবমাননাকর মনে করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গোলাম কুদ্দুছ। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, 'জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণা দেওয়া কিংবা না দেওয়াতে কবি হিসেবে নজরুলের কিছু যায় আসে না। কিন্তু আনুষ্ঠানিক ঘোষণা কিংবা গেজেট প্রকাশ না করা হয়ে থাকলে সেটি একটি জাতীয় ভুল। আমি আশা করব, বর্তমান সরকার সেই ভুল থেকে জাতিকে মুক্তি দেবে। কারণ, আমাদের মনে রাখতে হবে বঙ্গবন্ধুই কবি নজরুলকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে দেশে নিয়ে এসেছিলেন।'
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ বলেন, 'আমাদের স্বাধীনতার অন্যতম প্রাপ্তি কবি নজরুলের মতো অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীককে আমাদের মাঝে পাওয়া। তিনি আমাদের মাঝেই মিশে আছেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং বাংলার মানুষ এই কবিকে অনন্য মর্যাদায় ধারণ করেছে। তাঁকে রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতীয় কবির যে মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে, সেটা বিলম্বে হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে হওয়া উচিত।'
নজরুলসংগীতের বিশিষ্ট শিল্পী ও ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক খায়রুল আনাম শাকিল বলেন, নজরুলকে জাতীয় কবি হিসেবে মানুষ মনে-প্রাণে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ ব্যাপারে গেজেট না হয়ে থাকলে সেটা করে নেওয়া উচিত। এ কাজে নজরুল ইনস্টিটিউট উদ্যোগ নেবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
এ বিষয়ে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, জাতীয় কবি হিসেবে গেজেট না হওয়ার বিষয়টি তাঁর জানা নেই। তিনি বলেন, নজরুলকে বঙ্গবন্ধু এ দেশে শুধু নিয়েই আসেননি, তাঁকে ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডি-লিট ডিগ্রিও দিয়েছিলেন। জাতীয় কবি হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না হয়ে থাকলে কিংবা গেজেট প্রকাশ না হয়ে থাকলে এ ব্যাপারে সরকার উদ্যোগ নেবে, প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে বলেও তিনি জানান।
জন্মজয়ন্তী আজ

No comments

Powered by Blogger.