শ্রদ্ধাঞ্জলি-আলোকের ঝর্ণাধারায় by কাজী সুফিয়া আখ্তার

সুফিয়া কামাল সারা জীবন সমতাপূর্ণ সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা, শিশুর সার্বিক বিকাশের জন্য আনন্দময়-সহযোগী-পরিবেশ সৃষ্টি; বাঙালির সংস্কৃতি ও সাহিত্য কোনোভাবেই যাতে ক্ষুণ্ন না হয়, সে লক্ষ্যে সমাজ শক্তি জাগরণের বহুধা কর্মে নিয়োজিত ছিলেন।
এ লক্ষ্যে তিন-চারটি মঞ্চ থেকে তিনি সংগ্রাম করেছেন, আন্দোলন করেছেন। নেতৃত্ব দিয়েছেন
জাতির দুর্দিনে


সুফিয়া কামাল খুব আন্তরিকভাবে এ দেশের সব মানুষের সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার রাজনীতি করেছেন। তিনি কোনো দলীয় রাজনীতি কখনও করেননি। কারণ তাঁর রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায়িত হওয়ার কোনো অভিলাষ ছিল না। তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস প্রচলিত রাজনীতি থেকে ভিন্ন ছিল। সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারা প্রবহমান রাখতে বারবার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন দৃঢ়ভাবেই প্রত্যাশা করতেন, যাতে নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় যেতে, দেশ ও দশের উন্নয়নে নারী আরও ফলপ্রসূ, কার্যকর ভূমিকা ও অবদান রাখতে পারে এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে যে নারীরা সাংগঠনিক রাজনীতির মধ্যে ছিলেন, তাদের তিনি একটু অন্য দৃষ্টিতে দেখতেন। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে উৎসাহিত করতেন। সুফিয়া কামালের 'বোধ' বরাবরই খুব গভীর ছিল। তিনি ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারতেন যে, পুরুষ অধ্যুষিত রাজনীতির ক্ষেত্রে এই নারীদের নির্বাচনে জিতে আসা এবং মূল রাজনীতিতে স্থান করে নেওয়ার লড়াই কতটা কঠিন।
সুফিয়া কামাল সারা জীবন সমতাপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা, শিশুর সার্বিক বিকাশের জন্য আনন্দময়-সহযোগী-পরিবেশ সৃষ্টি; বাঙালির সংস্কৃতি ও সাহিত্য কোনোভাবেই যাতে ক্ষুণ্ন না হয়, সে লক্ষ্যে সমাজ শক্তি জাগরণের বহুধা কর্মে নিয়োজিত ছিলেন। এ লক্ষ্যে তিন-চারটি মঞ্চ থেকে তিনি সংগ্রাম করেছেন, আন্দোলন করেছেন। নেতৃত্ব দিয়েছেন জাতির দুর্দিনে। দেশের সংকটে জাতির অভিভাবক হিসেবে সংকট উত্তরণে দিকনিদের্শনা দিয়েছেন।
বাষট্টির ছাত্র আন্দোলনের সময় অনেক ছাত্র নেতাদের প্রতি হুলিয়া জারি হলে তাদের নিরাপদে রাখার জন্য সুফিয়া কামাল বিভিন্নজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের নিরাপদ আবাসের ব্যবস্থা করতেন। এই দুরূহ কাজে সেই সময় তাঁকে বেশি সহযোগিতা করেছিলেন নারী আন্দোলনের আরেক নেত্রী আশালতা সেন।
১৯৬৪ সালে সরকারি প্ররোচনায় পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা, খুলনা এবং উত্তরবঙ্গের কয়েকটি স্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়। সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক সমাজ দাঙ্গা প্রতিরোধে এগিয়ে আসেন। এই সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দাঙ্গা মিছিল বের করা হলে সুফিয়া কামাল নারীদের নিয়ে ওই মিছিলেও অংশ নেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কলকাতাতে তাঁর পরিচয় হয়েছিল এই দাঙ্গা প্রতিরোধের কাজ করার সময়। সেই পরিচয় ভাই-বোনে রূপ নেয়। জাতির পিতা তাঁকে বড় বোনের মতো শ্রদ্ধা করতেন। সুফিয়া কামাল তাকে ছোট ভাইয়ের মতো দেখতেন। ধানমণ্ডিতে দীর্ঘদিন কাছাকাছি বাস করেছেন। বিভিন্ন সময় দেশের অবস্থা নিয়ে আলাপ করেছেন। দুই ক্ষেত্রের এই দুই নেতা-নেত্রীর সখ্য সর্বজনবিদিত। সুফিয়া কামাল দুটি কবিতা তাকে নিয়ে লিখেছেন। একাত্তরের ডায়েরির অনেক পাতায় তিনি যেন ভালো থাকেন; আল্লাহ যেন তাকে ভালো রাখেন_ এই প্রার্থনার কথা লেখা আছে। দুই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে এখনও এই বন্ধন অটুট আছে।
১৯৭২ সালে জাতীয় সংসদে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসন এবং সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা রাখার জন্য সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর কাছে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। বঙ্গবন্ধুর কথা ইঙ্গিত করে তিনি সবসময় বলতেন, 'পঁচাত্তরের পরে আমি আর কোনো রাষ্ট্রনায়ক দেখি না।' ১৯৮৮ সালে বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভানেত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। একনিষ্ঠভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু কখনও আওয়ামী লীগের দলীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেননি।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির উচ্চ পর্যায়ের অধিকাংশ নেতার সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। পাকিস্তান আমলে তিনি পাক-সোভিয়েত মৈত্রী সমিতির সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এটি ছিল সেই সময় অনেক সাহসের একটি বিষয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় সভানেত্রীর নিরাপত্তার কথা ভেবে সোভিয়েত দূতাবাসের কূটনীতিকরা তাঁকে রাশিয়া যাওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু অন্য অনেকের দেওয়া প্রস্তাবের মতো তিনি সে প্রস্তাবও গ্রহণ করেননি। স্বাধীনতার পর সুদীর্ঘকাল বাংলাদেশ-সোভিয়েত মৈত্রী সমিতির সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু কোনোদিন পার্টি সদস্যপদ নেননি। তাদের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছেন, অনেক ইস্যুতে এক সঙ্গে কাজ করতে দ্বিধা করেননি। কিন্তু তিনি নিজের বিশ্বাস থেকে এক চুল কখনও নড়েননি। এসব ক্ষেত্রে তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা ও ঋজুতা সবসময় বজায় রেখেছেন।
প্রেসিডেন্ট এরশাদের শাসনামলে ছাত্রদের মিছিলে ট্রাক তুলে দেওয়া হয়েছিল এবং দু'জন ছাত্রের মৃত্যু হয়েছিল; জাতির সেই দুর্দিনে মহিলা পরিষদের কার্যালয়ে বসে তিনি কর্মীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, 'পাষাণ পাথরের ভেতর থেকে যেভাবে ঝর্ণা বেরিয়ে আসে তেমনিভাবে মুক্ত ধারার মতো বেরিয়ে আসো তোমরা।' স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তিনি ছিলেন সামনের সারিতে। নাগরিক অধিকার আদায়ে অসুস্থ শরীরে মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৯১ সালের ৩০ নভেম্বর এরশাদ সরকারের গণবিরোধী কারফিউ ভেঙে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের মৌন মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সুফিয়া কামাল। পুলিশের লাঠির সামনেও পিছপা হননি। পুলিশ বাধা দিলে প্রতিবাদ জানাতে সেদিন সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবীরা তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। অতি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় বলেছিলেন, 'আপনারা মায়ের মমতা নিয়ে দেশ পরিচালনা করেন।' দেশ শাসন করতে হবে মায়ের মততা দিয়ে_ এটা তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। যে ব্যক্তি দেশের মানুষকে ভালোবাসে না, সে ব্যক্তি দেশ শাসন করবে কীভাবে?
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের নবম জাতীয় সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মঞ্চে উপবিষ্ট সময় অত্যন্ত অন্তরঙ্গভাবে সুফিয়া কামাল ও প্রধানমন্ত্রী কিছু সময় আলাপে মগ্ন ছিলেন। শেখ হাসিনা তাঁর অত্যন্ত স্নেহভাজন। কিন্তু নবম জাতীয় সম্মেলনে সভাপতির ভাষণ প্রদানকালে সুফিয়া কামাল ঠিকই তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসের কথা এবং শেখ হাসিনার কাছে তাঁর প্রত্যাশার কথা বলতে ভুললেন না। সেদিন তিনি বলেছিলেন, 'আমাদের দেশের মহিলারা শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে এসেছে এ আমাদের পরম সৌভাগ্য। আজকে আমরা একজন মহিলা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এই সম্মেলনে উপস্থিত আছি। তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা। বহু দুর্দশা, বহু দুঃখ, বহু পথ অতিক্রম করে তিনি আজকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। আমাদের পরম সৌভাগ্য, আজকে তাঁকে নিয়ে আমাদের এই মহিলা পরিষদের বর্ষপূর্তির দিনে উৎসব করতে পারছি। আমার সমগ্র অন্তর দিয়ে কামনা করি যারা এখানে উপস্থিত আছেন, যারা দূরে আছেন সবার সঙ্গে একাত্ম হয়ে কামনা করছি, আমাদের এই মহিলা পরিষদে বেগম রোকেয়ার আদর্শ নিয়ে যে মহিলারা দাঁড়িয়েছে তাদের ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। আমাদের মনস্কামনা এতদিনে সিদ্ধ হয়েছে। আমি আন্তরিকভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। তিনি আমাদের এই অনুষ্ঠানে এসে আমাদের উৎসাহিত করেছেন এবং আশা করব মহিলা পরিষদ যে আশা করেছিল তার সম্মান তিনি রক্ষা করবেন মর্যাদার সঙ্গে। দেশকে, দেশবাসীকে, শুধু নারী সমাজ নয়, সমগ্র মানব সমাজের সঙ্গে তার অন্তরের যোগাযোগ থাকবে। তাদের মঙ্গল কামনায় জড়িত থাকবে।'
সুফিয়া কামাল দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, যারা দেশ শাসন করবেন তাদের সঙ্গে দেশের মানুষের অন্তরের যোগাযোগ থাকবে। থাকতে হবে। দেশ শাসন কর্তাদের চিন্তা-চেতনায় দেশের সমগ্র মানব সমাজের মঙ্গল কামনায় জড়িত থাকতে হবে। আদর্শ নিষ্ঠ, মানব ও প্রকৃতিপ্রেমী সুফিয়া কামাল সবসময়ই জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায় ও শ্রেণী নির্বিশেষে সব মানুষের কল্যাণ ও মঙ্গল কামনায় রাজনীতি করেছেন অনেক গভীর ও সূক্ষ্মভাবে, মানব ও সব প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা বিলিয়ে। নিবেদন করে। জাতির বিবেক কবি সুফিয়া কামালের শততম জন্মবার্ষিকীতে জানাই সশ্রদ্ধ শ্রদ্ধাঞ্জলি। তাঁকে স্মরণ করা, তাঁর কর্ম ও দর্শন নিয়ে আলোচনা, আজ আমাদের চিন্তার মুক্তি ও সমৃদ্ধির জন্যই প্রয়োজন।

কাজী সুফিয়া আখ্তার : লেখক ও গবেষক

No comments

Powered by Blogger.