২৮ মে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস-আয়েশা-সাহানাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি এখনো by তানজিনা হোসেন

দৃশ্যপট ১ ১৫ বছরের আয়েশাকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে সিএনজি অটোরিকশা থেকে নামানোই কঠিন হয়ে পড়েছিল তার ফুলেফেঁপে ঢোল হওয়া শরীরটার কারণে। তার ফোলা হাত-পা, পেটের মাঝে কচি ছোট্ট মুখটা দেখা যায় কি যায় না। রক্তচাপ ২১০/১২০, সঙ্গে শ্বাসকষ্টে মনে হয় যেন পটকা মাছের মতো খাবি খাচ্ছে।


প্রি অ্যাকলাম্পসিয়া। একনজর দেখেই প্রায় আঁতকে ওঠার উপক্রম ডিউটি ডাক্তারদের। যেকোনো মুহূর্তে এটি গর্ভকালীন খিঁচুনি, যা অ্যাকলাম্পসিয়াতে পরিণতি নেবে। হাতে সময় ভারী কম। তাড়াহুড়ো করে তোলা হলো অপারেশন টেবিলে। খানিক পর সিজারিয়ানের মাধ্যমে ভূমিষ্ঠ হলো স্বল্প ওজনের মৃতপ্রায় একটি শিশু। তার আধঘণ্টা পরই যা আশঙ্কা তাই সত্যি হলো। খিঁচুনি শুরু হলো আয়েশার। রক্তচাপ আবার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বন্ধ হয়ে গেল প্রস্রাব, অর্থাৎ কিডনিও বিকল হতে শুরু করেছে। বালিকা বধূর তরুণ স্বামীটি একজন ভ্যানচালক। কাজেই আইসিইউ, ডায়ালাইসিস ইত্যাদি শব্দ তার কাছে কোনো অর্থ বহন করে না। প্রিয় পাঠক, বালিকাটির কী দশা হয়েছিল তা জানতে না চাওয়াই ভালো। তবে জেনে রাখুন, সরকারি হাসপাতালগুলোর লেবার ওটিতে উঁকি দিলে প্রতিদিনই আয়েশাদের দেখা মিলবে। পরিবার ও সমাজ বিয়ে দিয়ে তাদের প্রতি দায়িত্ব পালন শেষ করেছে, কিন্তু তার পরবর্তী অধ্যায়—গর্ভকালীন প্রসূতি সেবা বা নিরাপত্তার বিষয়ে থেকেছে ততটাই উদাসীন। যেন গর্ভধারণের সব দায়দায়িত্ব এই ছোট্ট মেয়েটির একার।

দৃশ্যপট ২
বিয়ের চার মাস পর প্রথম মাসিক অনিয়মিত দেখে সাহানা প্রথমে প্রিয়তম স্বামী ফয়েজকেই জানিয়েছিলেন সংবাদটা। স্বামী তখন দোকান থেকে প্রস্রাব পরীক্ষার স্ট্রিপ এনে দিয়েছিলেন তাঁকে। এই গোটা নয় মাসে এটুকুই হলো ফয়েজের দায়িত্ব পালনের নমুনা। গর্ভধারণ যেহেতু সম্পূর্ণই একটি মেয়েলি বিষয়, তাই ফয়েজকে আর এর মধ্যে জড়ানো শোভন নয়, সাহানাকে উপদেশ-আদেশ দেওয়ার দায়িত্বটি শাশুড়ি, খালা ও ফুপুশাশুড়ি, পাড়াতুতো শাশুড়িরাই নিলেন। মফস্বল শহরের কলেজ পাস মেয়েটি এমনকি তাদের বিধিনিষেধের জাল এড়িয়ে একবার ডাক্তারও দেখাতে পারলেন না। শ্বশুরবাড়ির পুরোনো ধাত্রী সুফিয়ার মার তত্ত্বাবধানে থাকতে হলো তাঁকে। সময় এলে সেই সুফিয়ার মাকে ডাকা হলো। সাহানার কেবল অসহ্য ব্যথা আর ব্যথা। গোটা দিন গেল। অন্তহীন ব্যথা আর শেষ হয় না। কানের কাছে কেবল চাপ দাও, আরও চাপ দাও। একসময় পৃথিবী ঝাপসা হয়ে এল। তারপর আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফিরে সে নিজেকে আবিষ্কার করে সদর হাসপাতালের নোংরা বেডে। দুই দিনের অবিরাম প্রসববেদনা সত্ত্বেও ছোট শ্রোণীচক্রের কারণে প্রসব সম্ভব হয়নি সাহানার। খবর পেয়ে তাঁর বাবা ছুটে গিয়ে যখন হাসপাতালে নিয়ে আসেন, তখন পানিশূন্য, জ্বরাক্রান্ত, সংজ্ঞাহীন, হাত দিয়ে ঘাঁটাঘাঁটির কারণে জীবাণু সংক্রমণে আক্রান্ত সাহানা ততক্ষণে সেপটিক শক অর্থাৎ মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পৌঁছেছে। পেটের বাচ্চাটি মায়ের এই শোচনীয় অবস্থা দেখার জন্য আর বেঁচে নেই। হ্যাঁ, জীবন-মরণ যুদ্ধে সাহানা শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছে বটে, কিন্তু অবস্ট্রাকটেড লেবারের কারণে জরায়ুর চাপে ছিদ্র হয়ে গেছে তার মূত্রথলি, যাকে ডাক্তারি ভাষায় বলে ভেসিকো ভ্যাজাইনাল ফিস্টুলা। প্রস্রাব আর নিয়ন্ত্রণে নেই তাঁর। অবিরাম প্রস্রাব ঝরার কারণে স্বামী পরিত্যাগ করেছেন তাঁকে। তিনি এখন অচ্ছুত, নোংরা। ফিরে এসেছেন বাপের বাড়ি। শুনেছেন, ফয়েজ আবার বিয়ে করবেন।

অন্তহীন ব্যথার গল্প
প্রতিবছর ২৫ লাখ মেয়ে গর্ভবতী হয় আমাদের দেশে। এর মধ্যে সাড়ে তিন লাখের বেশি মেয়ের এমন সব জটিলতা দেখা দেয় যে তা মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে। কিন্তু হাসপাতাল, প্রশিক্ষিত ধাই বা চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে সন্তান প্রসব হয় মাত্র ২৪ শতাংশ মেয়ের (সূত্র: ইউনিসেফ)। বাকিরা বিনা সেবায়, বিনা চিকিৎসায় আঁতুড়ঘরে নোংরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সন্তান প্রসব করতে বাধ্য হয় এবং নানা রকমের জটিলতায় আক্রান্ত হয়। প্রতি ১১০ জন মেয়ের মধ্যে একজন বাংলাদেশি মেয়ে প্রসবকালীন মৃত্যুঝুঁকির মধ্যে থাকে। অথচ মাতৃত্ব বা গর্ভধারণ কোনো রোগ নয়, অসুখ নয়। এটি নারীর জীবনের এক বিশেষ সময় ও বিশেষ অবস্থা, যার মধ্য দিয়ে একটি জাতি তার বিকাশ ও টিকে থাকাটাকে নিশ্চিত করে। মাতৃত্ব এমন একটি বিষয় যার দায়দায়িত্ব মেয়েটির একার কখনোই নয়; তার পরিবারের, সমাজের এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এই সময় তাকে নিরাপত্তা ও নির্ভরতা দেওয়া। অথচ আমাদের দেশে মাতৃত্ব মানে একটি অসহায় ও একাকী মেয়ের অন্তহীন ব্যথাবেদনার কাহিনি। মাতৃত্ব তার ওপর এমন সব বিধিনিষেধ ও সংস্কার চাপিয়ে দেয় যে তার জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। যথাযথ যত্ন ও শুশ্রূষার অভাবে একসময় তার জীবন বিপন্ন হয়ে ওঠে। গর্ভকালীন সব বিপদ-আপদ, কষ্ট, বেদনা, জীবনাশঙ্কা—সবকিছু নারীকে একাই বহন করতে হয়। কিন্তু তা কেন হবে? আমরা শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমানোতে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছি। আগামী ২০১৫ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যু প্রতি মিলিয়নে ১৪৩-এ নামিয়ে আনার মধ্য দিয়ে মিলেনিয়াম গোল পূরণের পথে চলেছি আমরা। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে রোল মডেল বলে গেছেন অর্মত্য সেন বা সোনিয়া গান্ধীর মতো ব্যক্তিত্বরা। এসব সাফল্যের জন্য গত বছর বাংলাদেশ জাতিসংঘের পুরস্কারও পেয়েছে। তবু আয়েশা-সাহানাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি এখনো। এখনো হাজার হাজার মেয়ে জীবন হারায় বা চিরতরে অসুস্থ হয় মাতৃত্বের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে। পরিসংখ্যানের সাফল্য নয়, দাতা সংস্থাদের বাহবা নয়—আসুন, নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসে আমাদের চাওয়া হোক, প্রতিটি মেয়ের মাতৃত্ব হবে নিরাপদ, মধুর, উচ্ছ্বাসপূর্ণ। প্রতিটি মেয়ের নিরাপদ মাতৃত্বের অধিকার নিশ্চিত হবে এ দেশে।

No comments

Powered by Blogger.