পাল্লা দিয়ে কমছে সূচক, গতি নেই লেনদেনে

লেনদেনে গতি নেই, শেয়ার কেনাবেচায় নেই বিনিয়োগকারীদের প্রবল আগ্রহ। প্রতিদিনই কমছে শেয়ারের দাম। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নামছে বাজারের সূচক। কখনো বড় পতন, কখনো অল্প। সব মিলিয়ে শেয়ারবাজারে এখন যেন এক ঝিমিয়ে পড়া পরিবেশ।


বাজার বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাজার-সম্পর্কিত বা মূল্য সংবেদনশীল তথ্যে বাজার যতটা না প্রভাবিত হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি প্রভাবিত হচ্ছে পারিপার্শ্বিক নানা ঘটনায়। তাই বাজারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একধরনের দ্বিধা কাজ করছে। একসময় নিয়মিত বেচাকেনায় সক্রিয় অনেক সাধারণ বিনিয়োগকারী বাজার থেকে কিছুটা দূরে রয়েছেন। আর প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদেরও গতিময়তার লক্ষণ নেই।
সরকারের পক্ষ থেকে বাজেটে পুঁজিবাজারের জন্য বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা অপরিবর্তিত রাখার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তারও কোনো ইতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। এটাও একধরনের আস্থাহীনতারই প্রতিফলন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সব মিলিয়ে মৌলভিত্তির পরিবর্তে বাজার এখন অনেকটাই আবেগনির্ভর বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁদের মতে, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মনস্তাত্ত্বিক ধারণা বা ভাবনার প্রতিফলন ঘটছে বাজারে, যার সঙ্গে বাজারের স্বাভাবিক নিয়মের কোনো যোগসূত্র নেই।
শেয়ারবাজারে গতকাল মঙ্গলবারও দরপতন ঘটেছে। এ নিয়ে টানা ছয় দিন বাজারে দরপতনের ঘটনা ঘটল। প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাধারণ মূল্যসূচক গত ছয় দিনে প্রায় ৩৯২ পয়েন্ট কমেছে। এর মধ্যে গতকাল দিন শেষে ১৪ পয়েন্ট কমে সাধারণ সূচক নেমে এসেছে চার হাজার ৬৩১ পয়েন্টে, যা চলতি বছরের ১৮ মার্চের পর সর্বনিম্ন। যদিও গতকাল লেনদেনের একপর্যায়ে ডিএসইর সাধারণ সূচক আগের দিনের চেয়ে প্রায় ১১৬ পয়েন্ট কমে নেমে এসেছিল চার হাজার ৫৩০ পয়েন্টে। কিন্তু লেনদেনের শেষ দেড় ঘণ্টায় কিছু প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর সহায়তায় বড় ধরনের দরপতন ঘটেনি।
লেনদেনও আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। ২১ মে ডিএসইতে ৪৭৭ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছিল। ওই দিন উচ্চ আদালত শেয়ার ধারণসংক্রান্ত একাধিক রিটের রায় ঘোষণা করেন। আর পাঁচ কার্যদিবসের ব্যবধানে গতকাল সেটি নেমে এসেছে প্রায় ২৩৬ কোটি টাকায়। এর আগের তিন কার্যদিবস ডিএসইতে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ২০০ কোটি টাকার নিচে।
জানতে চাইলে এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজারের বর্তমান দরপতনের যৌক্তিক কোনো কারণ রয়েছে বলে আমার মনে হয় না। কয়েকটি কোম্পানির পরিচালকদের রিটের বিষয়টি নিয়ে বর্তমানে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা ভর করেছে। এর ফলে অনেক বিনিয়োগকারী কেনাবেচায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন।’
সিদ্দিকী আরও বলেন, ‘বিনিয়োগযোগ্য বাজারে কেন বিনিয়োগকারীরা এমন আচরণ করছেন, সেটি আমার বোধগম্য নয়। আর আমি জানি না আদালতের দায়ের করা রিটের ফলাফল যা-ই হোক, তাতে কোম্পানির বা বাজারের মৌলিক কাঠামোর গুণগত কোনো পরিবর্তন হবে কি না।’ তাঁর মতে, বিভিন্ন আইনকানুন ও বিধিবিধানের মাধ্যমে বারবার হস্তক্ষেপের ফলেই বাজার এমন আচরণ করছে। কিছুতেই বাজার স্থির হচ্ছে না। অস্থির বাজারে তাই স্থির কোনো বিনিয়োগ হচ্ছে না। ফলে লেনদেনের গতিও কমে গেছে।
তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের ন্যূনতম শেয়ার ধারণের বিষয়ে এসইসির নির্দেশনা ও তার বিরুদ্ধে আদালতে দায়ের হওয়া একাধিক রিট আবেদন ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে নতুন করে অস্থিরতা তৈরি হয়। অবশ্য অনেকের ধারণা ছিল, আদালতের রায় এসইসির পক্ষে এলে বাজারে আবারও গতি ফিরবে। কিন্তু সেটি হয়নি। ন্যূনতম শেয়ার ধারণের বিষয়ে এসইসির নির্দেশনার বিরুদ্ধে দায়ের করা একাধিক রিটের শুনানি শেষে ২১ মে উচ্চ আদালত রায় দেন। তাতে এসইসির নির্দেশনাটিকে বৈধ ঘোষণা করা হয়। এরপর এসইসির এ-সংক্রান্ত (২সিসি) ক্ষমতা চ্যালেঞ্জ করে একাধিক রিট করা হয় উচ্চ আদালতে, যা বর্তমানে প্রধান বিচারপতির বিবেচনাধীন রয়েছে।
আদালতের রায়ে এসইসির নির্দেশনাটি বৈধ ঘোষণার ফলে তালিকাভুক্ত অনেক কোম্পানির পরিচালককে পদ ছাড়তে হবে। কারণ, নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে তাঁরা ন্যূনতম শেয়ার ধারণে ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু নির্দেশনাটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা তৈরি হয়েছে। ২২ মে পরিচালকদের শেয়ার কেনার জন্য বেঁধে দেওয়া সময়সীমা শেষ হয়ে গেলেও পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে এসইসির পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। শুধু বলা হয়েছে, রায়ের পর নির্দেশনা পরিপালনের লক্ষ্যে সংস্থাটি প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করেছে।
এদিকে, তালিকাভুক্ত কোম্পানির যেসব উদ্যোক্তা-পরিচালকের হাতে দুই শতাংশের কম শেয়ার রয়েছে এবং এসইসির নির্দেশনা বাস্তবায়িত হলে যাঁদের পদ ছেড়ে দিতে হবে, তাঁদের হাতে থাকা শেয়ার বিক্রির ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা বা বাধ্যবাধকতা নেই। এখন একযোগে যদি সেই বিক্রির চাপ তৈরি হয়, তাহলে বাজার তা ধারণ করতে পারবে কি না, এ নিয়েও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বাজার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে এসইসির চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। পরে এ বিষয়ে এসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সাইফুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি মোহাম্মদ এ হাফিজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদালতের রায়ের পর বাজার যেভাবে আচরণ করবে বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল, সেভাবে আচরণ করেনি। আবার অনেক সময় ব্যক্তিশ্রেণীর বিনিয়োগ নানা ধরনের হুজুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে। তেমন পরিস্থিতিতে দরকার হয় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ। কিন্তু আমাদের বাজারে বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ খুবই কম। সুযোগ থাকার পরও এই বিনিয়োগ তেমন একটা বাড়ছে না।’
গতকালের শেষ ঘণ্টায় বাজারের সূচক উত্থানের পেছনে ভূমিকা রেখেছে কয়েকটি বড় ব্রোকারেজ হাউস। এসব হাউস থেকে গতকাল বড় অঙ্কের শেয়ার কেনা হয়েছে। এসইসি ও ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, বড় বড় প্রায় সব কটি ব্রোকারেজ হাউস গতকাল বাজারে ক্রেতার ভূমিকায় ছিল। এদের মধ্যে শীর্ষে ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান আইসিবি সিকিউরিটিজ।
বিশেষ স্কিম: শেয়ারবাজার ধসে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার জন্য গঠিত বিশেষ স্কিম কমিটির সুপারিশ গ্রহণ করেছে এসইসি। গতকাল কমিশন সভায় এসব সুপারিশ গ্রহণ করা হয়। একই সঙ্গে কমিটির দেওয়া ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীর তালিকাটিও গ্রহণ করেছে এসইসি। ওই তালিকার ভিত্তিতে করা কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য এসইসি সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ দেবে বলে জানানো হয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের এক বছরের সুদের ৫০ শতাংশ মওকুফ ও শেয়ারের প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওতে ২০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণের সুপারিশ করেছে বিশেষ স্কিম কমিটি।
শেয়ারবাজারে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা নিজস্ব অর্থ বিনিয়োগ করে তার বিপরীতে যাঁরা ঋণসুবিধা নিয়েছেন, কেবল তাঁরাই সুদ মওকুফের সুবিধা পাবেন। আর ঋণগ্রস্ত বা ঋণ ছাড়া উভয় ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারী আইপিও কোটাসুবিধা পাবেন। ২০১২ ও ২০১৩ সালে ইস্যু হওয়া সব আইপিওতে ২০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণের প্রস্তাব করেছে কমিটি।

No comments

Powered by Blogger.