বাজেট-পেনশনভোগীদের সঞ্চয়পত্র ও সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী by জামিল ওসমান

সম্প্রতি প্রথম আলোতে ‘সঞ্চয়পত্রের সুদ করের আওতায় এল’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর তা সংশ্লিষ্ট সব মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ইতিমধ্যে পেনশনার্স সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার হ্রাস এবং এ থেকে অর্জিত আয়কে করের আওতায় আনার বাজেট প্রস্তাবের ওপর পেনশনভোগী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গণমাধ্যম ও বিভিন্ন ফোরামে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।


আমার ধারণা, সরকার এ বিষয়ে একটি ন্যায়ানুগ সিদ্ধান্ত না দেওয়া পর্যন্ত পেনশনভোগীদের অসন্তোষের মাত্রা ক্রমান্বয়ে বাড়বে।
২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেট-বক্তৃতায় মাননীয় অর্থমন্ত্রী বললেন, বাজেট কার্যক্রমের এক নম্বর মৌলিক লক্ষ্য হবে ‘সামাজিক সুবিচার ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করা’। তারই আলোকে তিনি পেনশনভোগীদের সঞ্চয়পত্র থেকে উদ্ভূত আয়কে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর (Social Safety Net) আওতাভুক্ত গণ্য করে সম্পূর্ণভাবে আয়কর থেকে অব্যাহতি দেন। তাঁর এই সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত সবার প্রশংসা অর্জনে সক্ষম হয়। কিন্তু বছর না ঘুরতেই সরকারের গৃহীত একটি প্রশংসনীয় আর্থসামাজিক কার্যক্রম বিশেষজ্ঞ মুদ্রা/রাজস্ব নীতিবিদদের খোলাবাজার অর্থনীতির তাত্ত্বিক ধ্যান-ধারণার নির্মম শিকার হতে চলেছে। যারা সরকারের জনকল্যাণমুখী কার্যক্রম নস্যাৎ করে সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাস করতে তৎপর, তাদের ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখার প্রয়োজন রয়েছে।
২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেটে পেনশনভোগীদের সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার হ্রাস এবং অর্জিত আয়ের ওপর করারোপ-সংক্রান্ত সামাজিক ন্যায়বিচার-বিবর্জিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে তা বর্তমান জনবান্ধব ও জনকল্যাণমুখী সরকারের মৌলিক চরিত্রের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হবে না। এর ফলে দরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত প্রায় পাঁচ লাখ পেনশনভোগী পরিবার, যাদের আয়ের একমাত্র উৎস হচ্ছে পেনশনভোগীদের সঞ্চয়পত্র, তারা সবাই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এবং এই দুর্মূল্যের বাজারে সংসারের খরচ মেটাতে গিয়ে রীতিমতো গলদঘর্ম হবেন।
সরকারি ও পেনশনভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগের একটা তুলনামূলক চিত্র বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রজাতন্ত্রের বেতনভোগী চাকরিজীবী। তাঁরা বেতন ও বোনাস ছাড়াও নানাবিধ ভাতা, সরকারি বাড়ি এবং প্রাধিকার অনুযায়ী গাড়ি, তেল, গ্যাস, ড্রাইভার পান। তাঁদের বেতনের আয়ের ওপর যে কর দেওয়া হয়, তা তাঁরা সরকারের কাছ থেকে সম্পূর্ণ ফেরত পেয়ে থাকেন। সর্বোপরি একজন সরকারি কর্মকর্তার ভবিষ্য তহবিলে জমাকৃত অর্থের ওপর ১২.৫ শতাংশ হারে যে সুদ চক্রবৃদ্ধি হারে হিসাব করা হয়, তা সম্পূর্ণ করমুক্ত। পক্ষান্তরে পেনশনভোগীদের ক্ষেত্রে মাসিক পেনশন এবং পেনশনভোগীদের সঞ্চয়পত্র থেকে অর্জিত মুনাফা ছাড়া আয়ের বিশেষ কোনো উৎস নেই। পেনশন আয় করমুক্ত এবং বর্তমান আইন অনুযায়ী পেনশনার্স সঞ্চয়পত্রে গচ্ছিত কেবল প্রভিডেন্ট ফান্ড ও পেনশনের টাকার ওপর অর্জিত মুনাফাও আয়করমুক্ত। এ অবস্থায় ভবিষ্য তহবিল থেকে চক্রবৃদ্ধি হারে অর্জিত সুদ-আয়কে করের আওতায় না এনে এবং বেতন-আয়ের ওপর ধার্যকৃত কর সরকারি তহবিল থেকে প্রত্যর্পণকরণের বিদ্যমান ব্যবস্থা প্রত্যাহার না করে শুধু পেনশনার্স সঞ্চয়পত্র থেকে উদ্ভূত আয়কে করের আওতায় আনা হলে তা সামাজিক ন্যায়বিচার পরিপন্থী কর্মকাণ্ড বলে বিবেচিত হবে। তা ছাড়া সরকারি ভবিষ্য তহবিলের ওপর ১২.৫ শতাংশ হারে সুদ প্রদানের বিষয়টি পুনর্মূল্যায়ন না করে কেবল পেনশনভোগীদের সঞ্চয়পত্রের ওপর প্রদেয় মুনাফার হার হ্রাস করা হলে সামাজিক বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করবে।
পেনশনভোগীদের সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার হ্রাস করে এবং এ থেকে উদ্ভূত আয়কে করের আওতায় আনলে বাজেটে এর অবদান খুবই নগণ্য হবে। জাতীয় সঞ্চয় ব্যুরোর হিসাবমতে, এপ্রিল ২০১০ পর্যন্ত বিগত ১০ মাসে পেনশনারস সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ ছয় হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। এর ওপর শতকরা ১২ দশমিক ৫ ভাগ হারে প্রদেয় মুনাফার অঙ্ক দাঁড়াবে ৪৭৩ কোটি টাকা এবং শতকরা ১০ ভাগ হারে উৎসে আয়কর কর্তন হবে মাত্র ৪৭ দশমিক ৩ কোটি টাকা। বার্ষিক হিসাবে এ অঙ্ক দাঁড়াবে মাত্র ৫৬ কোটি টাকায়। ২০১০-১১ সালের এক লাখ ৩২ হাজার ১৭০ কোটি টাকার বাজেটে ৫৬ কোটি টাকার অবদান হবে যৎসামান্য। পক্ষান্তরে পেনশনভোগীদের মোট আয় কর-নেটের অন্তর্ভুক্ত হলে তাঁদের আয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আয়কর হিসেবে দিতে হবে। অথচ রাজস্ব কার্যক্রমে অধিকতর মনোযোগী হলে সরকারের পক্ষে ৫৬ কোটি টাকা বেশি আদায় করতে বিশেষ বেগ পেতে হবে না। অতএব, সামাজিক ন্যায়বিচারের স্বার্থে পেনশনারস সঞ্চয়পত্রের ব্যাপারে সরকারের বর্তমান অনুসৃত নীতি থেকে বিচ্যুত হওয়া সঠিক সিদ্ধান্ত হবে না।
সরকার তিন বছর ও পাঁচ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর কোনো রকম ছাড় ছাড়াই উৎসে কর কর্তনের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা সমর্থনযোগ্য। এগুলোর ক্ষেত্রে বর্তমানেও কর আদায়যোগ্য। কিন্তু উৎসে কর কর্তনের সময় বিশেষ শিথিলতা প্রদর্শন এবং উচ্চহারে অব্যাহতি (একক নামে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং যুগ্ম নামে তিন লাখ টাকা) দেওয়ার কারণে এ ক্ষেত্রে কর ফাঁকির হার সর্বোচ্চ। এর ফলে সরকার প্রতিবছর বিপুল অঙ্কের রাজস্ব আদায় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ দুটি সঞ্চয়পত্রের বেলায় ১০ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তনের বিধানটি কিছুটা শিথিল করে পাঁচ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তন করা সংগত হবে। কারণ, উচ্চবিত্তদের বেলায় জমি ও বাড়ি রেজিস্ট্রেশনের সময় উৎসে কর কর্তনের হার মাত্র দুই শতাংশ। তা ছাড়া জমি/বাড়ি/ফ্ল্যাটের বিক্রেতাদের বিক্রয়লব্ধ মূলধনি প্রাপ্তির ওপর মাত্র দুই শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তনপূর্বক একে চূড়ান্ত করদায় হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। তাই তিন ও পাঁচ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রের ওপর পাঁচ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তন করা হলে কর ফাঁকির প্রবণতা অনেকটা হ্রাস পাবে। আর এর মুনাফার ওপর উৎসে কর্তিত করকে আগের মতো চূড়ান্ত করদায় হিসেবে বিবেচনা করা হলে সাধারণ সঞ্চয়পত্রের মালিকদের অহেতুক হয়রানির অবসান হবে।
জামিল ওসমান: সাবেক তথ্যসচিব।

No comments

Powered by Blogger.