ঝুলে গেছে সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট-প্রশাসনে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাই নেপথ্য কারণ by আশরাফুল হক রাজীব

প্রশাসনে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তাবিত সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। খসড়া এ আইনের ওপর আবারও মতামত নেওয়া হবে। ফলে জনমুখী প্রশাসন গড়ার অন্যতম ভিত্তি সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট প্রণয়ন না করার ইঙ্গিত মিলছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সাবেক মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক হাফিজউদ্দিন খান কালের কণ্ঠকে বলেন, বিধি দিয়ে প্রশাসন পরিচালনা সহজ। কারণ সহজে বদলানো যায়। এতে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যায়। আইন হলে যখন-তখন বদলানো যাবে না। এজন্য সব সরকারই এ ধরনের আইন করা থেকে দূরে থেকেছে।
মহাজোট সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরই সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়। একই উদ্যোগ ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের। কিন্তু তারা নির্বাচিত সরকারের জন্য এ বিষয়ে অধ্যাদেশ জারি করেনি। এর আগে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন জোট সরকারও সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু সরকারের সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের বাধার মুখে আইনটি আলোর মুখ দেখেনি। গত বছরের মার্চ মাসে প্রস্তাবিত খসড়া আইনের বিষয়ে সাধারণ মানুষের মতামত নিতে আইনটি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। পাঁচ শতাধিক ব্যক্তি ও সংগঠন আইনটির ওপর মতামত দেয়। এ ছাড়াও সাত বিভাগে সেমিনার করে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মতামত নেওয়া হয়। এরপর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটির মাধ্যমে সব পক্ষের মতামত সমন্বয় করে আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়। প্রস্তাবটি প্রশাসনিক উন্নয়ন-সংক্রান্ত সচিব কমিটিতে উত্থাপনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নিতে গত ডিসেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত তা ফিরে আসেনি।
আইনটি বাস্তবায়ন হলে কর্মকর্তাদের নিয়োগ, বদলি, পদায়ন ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হতো। প্রশাসনের ওপর দলীয়করণের খড়গ অনেকাংশে কমত। বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়ার কালাকানুন থাকত না। মেধাবী কর্মকর্তারা নির্ভয়ে কাজ করতে পারতেন। প্রস্তাবিত এই অ্যাক্টে ২৮টি আলাদা ক্যাডার সার্ভিস প্রথা তুলে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কাজের ধরন বিবেচনায় ক্যাডারগুলোকে বিশেষায়িত কয়েকটি গুচ্ছে বিভক্ত করা হবে। মন্ত্রণালয়গুলোকে জনপ্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা, প্রকৌশল ও গবেষণা, কৃষি, শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন- এসব নামে সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১৫টি মন্ত্রণালয়ে বিভক্ত করা হবে। এর ফলে প্রশাসনের গতি ফিরে আসবে। সাধারণ মানুষও গতিশীল প্রশাসনের সেবা পাবে।
এরপরও খসড়া আইনটিতে কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। বিসিএস সমন্বয় কমিটির মতে, সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট অসংগতিপূর্ণ। কমিটি সংবাদ সম্মেলন করে সরকারি কর্মকর্তাদের অবসরের বয়সসীমা ৬৫ বছর করার সুপারিশ করেছে। কমিটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে আন্তক্যাডার সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব করে। গতিশীল প্রশাসন গড়ার ক্ষেত্রে বিদ্যমান প্রেষণে নিয়োগ ব্যবস্থা বড় ধরনের অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে বলে মনে করে কমিটি। তাদের মতে, প্রেষণে কর্মকর্তা নিয়োগের ফলে বছরের পর বছর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা পদোন্নতি পাচ্ছেন না। ফলে তাঁদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হচ্ছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলি খান কালের কণ্ঠকে বলে, 'সব সরকারই প্রশাসনে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ চায়। এ কারণেই সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট হচ্ছে না। খসড়া করেও পিছিয়ে আসছে সরকার।'
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে উপসচিব থেকে সচিব পর্যায়ে দফায় দফায় পদোন্নতি হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলেও পদোন্নতি হচ্ছে। কিন্তু এসব পদোন্নতির পেছনে অনিয়ম কাজ করছে। সর্বশেষ গত ৮ ফেব্রুয়ারি প্রশাসনের তিন স্তরে উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে ৬৮১ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ফলে বর্তমান সরকারের আমলে প্রায় এক হাজার ৯০০ কর্মকর্তাকে উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এ পদোন্নতি দিতে গিয়ে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অন্যায়ভাবে সমানসংখ্যক কর্মকর্তাকে বাদ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। নীতিমালার মারপ্যাঁচে প্রয়োজনীয় নম্বর নেই- এ অজুহাতে অনেককে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, নম্বর না থাকার পরও কারো কারো বেলায় পদোন্নতি জুটেছে। ফলে জনপ্রশাসনে বিশৃঙ্খলার পাশাপাশি ক্ষোভ ও হতাশা বাড়ছে। ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর সচিবালয়ে সচিবদের সঙ্গে এক বৈঠকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেছিলেন, যোগ্যতা, দক্ষতা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পদোন্নতি হবে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় গিয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও অফিসার্স ক্লাবের এক অনুষ্ঠানে যোগ্যতার ভিত্তিতে পদোন্নতির ঘোষণা দিয়েছিলেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রধানমন্ত্রীদের এসব ঘোষণা বাস্তবায়ন হয়নি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্টো ঘটনা ঘটেছে।
সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সংস্থাপনবিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কয়েকটি স্টেক হোল্ডার এ ব্যাপারে তাদের মতামত দিতে পারেনি। এ কারণে আবারও মতামত নেওয়া হবে। এতে আইনটি ঝুলে যায়নি। বর্তমান সরকারই আইনটি প্রণয়ন করবে।'
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সিভিল সার্ভিস আইনের প্রধান অন্তরায় সরকার সমর্থক জুনিয়র কর্মকর্তারা। খসড়া আইনে বলা হয়েছে, প্রতিটি পদে পদোন্নতি পেতে হলে লিখিত পরীক্ষা দিতে হবে। পরীক্ষায় উত্তীর্ণরাই কেবল পদোন্নতির যোগ্য বিবেচিত হবেন। কিন্তু সরকার সমর্থক জুনিয়র কর্মকর্তারা বলছেন, 'বর্তমানে যাঁরা সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব হয়েছেন, তাঁরা লিখিত পরীক্ষা দিয়ে পদোন্নতি পাননি। আমাদের কেন পরীক্ষায় বসানো হচ্ছে।' নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিব বলেন, 'সরকারের সচিবরা চাচ্ছেন লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতি পেতে হবে। এটা না হলে সিভিল সার্ভিসের নাকি মান থাকবে না। তাঁরা কি মান রেখেছেন? বর্তমানে একাধিক সচিব রয়েছেন, যাঁরা তাঁদের সিনিয়রকে ডিঙিয়ে পদোন্নতি পেয়েছেন। মেধাতালিকার প্রথম দিকে থেকেও সচিব হতে পারেননি। অনেক সচিব মেধাতালিকার শেষের দিকে রয়েছেন। তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন রাজনৈতিক দলবাজি না করলে স্বাভাবিক নিয়মে পদোন্নতি পাবেন না। সর্বোচ্চ পদপ্রাপ্তি নিশ্চিত হওয়ার পর তাঁরা লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে মেধা যাচাই-বাছাই করে পদোন্নতির নিয়ম করতে চাচ্ছেন। এটা আমরা চাই না।'
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব আবদুস সোবাহান সিকদার কালের কণ্ঠকে বলেন, পরীক্ষার মাধ্যমেই পদোন্নতি দেওয়া উচিত। অতীতে কী হয়েছে তার দোহাই দিয়ে ভবিষ্যতের সিভিল সার্ভিসকে নষ্ট করা যাবে না। মানসম্পন্ন সিভিল সার্ভিস পেতে হলে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
সিভিল সার্ভিস অ্যাক্টের ওপর নতুন করে মতামত নেওয়ার কারণ কী জানতে চাইলে জনপ্রশাসন সচিব বলেন, কয়েকটি পেশাজীবী সংগঠন বলেছে, 'তারা মতামত দিতে পারেনি। তাই নতুন করে তাদের মতামত নেওয়া হবে। পেশাজীবী সংগঠন ছাড়াও সুশীল সমাজ, সাংবাদিক ও সাবেক কর্মকর্তাদের সঙ্গেও মতবিনিময় সভা করার পরিকল্পনা রয়েছে।'
সংবিধানের ১৩৩ অনুচ্ছেদে বেসামরিক প্রশাসন আইনের মাধ্যমে পরিচালনার বিধান থাকলেও গত ৪০ বছরে কোনো সরকারই সেই আইন প্রণয়ন করেনি। যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে একটি করে কমিশন কিংবা কমিটি গঠন করেছে। এর পেছনে কোটি কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এসব কমিটি বা কমিশন যেসব সুপারিশ করেছে তার সামান্য বাস্তবায়ন হলেও বাস্তবায়ন হয়নি বেশির ভাগ সুপারিশ। প্রতিটি সরকারই পছন্দমাফিক নীতিমালা করে প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করেছে, যার ফলে দলীয় প্রশাসন গড়ে উঠেছে।

No comments

Powered by Blogger.