আইন-তথ্য অধিকার ও দুর্নীতি দমন by সাদেকা হালিম

দুর্নীতি দমন কমিশন আইন পরিবর্তনের বিলে বলা হয়েছে, বিচারপতি, ম্যাজিস্ট্রেট এবং সরকারি আমলাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ দাখিলের আগে 'দুদক'কে অবশ্যই সরকারের অনুমতি নিতে হবে। তবে 'দুদক' মনে করে, আইনের এহেন পরিবর্তনে 'দুদক' অধিকতর দুর্বল এবং অকার্যকর হয়ে পড়বে এবং সেটা সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে
বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে মানবেতর জীবনযাপন করে।


তারা মৌলিক চাহিদাগুলো ঠিকমতো পূরণ করতে পারে না। অথচ এই দেশে এক শ্রেণীর স্বার্থান্বেষী মানুষ সমাজের প্রতিটি স্তরে দুর্নীতি করে বিত্তশালী হচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিশীল চাকাকে পেছন দিক থেকে জোরেশোরে লাগাম টেনে ধরছে। দেশের অর্থনীতি যখন দুর্নীতি দ্বারা ভারাক্রান্ত হচ্ছে, এমন সময়ে যুগোপযোগী তথ্য অধিকার আইন-২০০৯ জাতীয় সংসদ কর্তৃক গৃহীত হয়। অদ্যাবধি প্রায় দুুই বছর অতিক্রান্ত হলেও দেশের আপামর জনসাধারণের একটি বিশাল অংশ এখনও তথ্য অধিকার আইন কী, কোথায় কোথায় তথ্য অধিকার আইন ব্যবহার/প্রয়োগ করা যায়, তথ্য না পেলে কোথায় অভিযোগ ও আপিল করতে হয়_ এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ওয়াকিবহাল নয়। তথ্য অধিকার হলো মানুষের মৌলিক মানবাধিকার। পৃথিবীর প্রায় ৮৮টি দেশ 'তথ্য অধিকার'কে আইনগতভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তথ্য অধিকার আইনের সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে দুর্নীতি প্রতিরোধ, দায়িত্বশীল সরকার, প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সম্ভব।
অন্যদিকে, দুর্নীতি দমন কমিশন অ্যাক্ট (২০০৪)-এর উদ্দেশ্য হলো দুর্নীতির বেড়াজাল থেকে দেশকে রক্ষা করা। অর্থাৎ বাংলাদেশের যে স্তরেই দুর্নীতি হোক না কেন, এই আইন ব্যবহার করে তদন্ত ও অনুসন্ধান করে কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া। এ ক্ষেত্রে তথ্য অধিকার আইন দুর্নীতি প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। দুর্নীতি দমন আন্দোলনের ধারাকে আরও গতিশীল ও যুগোপযোগী করতে তথ্য অধিকার আইন মাইলফলক হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। যদিও বাংলাদেশ সংবিধানে তথ্য অধিকার আইন বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা নেই, কিন্তু সংবিধানের ৭, ৩২ এবং ৩৯ ধারাকে আমরা তথ্য অধিকার আইনের ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। তথ্য অধিকার আইন-২০০৯-এর ৮টি অধ্যায়ে ৩৭টি ধারা রয়েছে। এসব ধারার মধ্যে ৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ২০টি বিষয়ে সরকার তথ্য দিতে বাধ্য নয় এবং ধারা ৩২ অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কার্যে নিয়োজিত সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এই আইন প্রযোজ্য নয়। তবে এসব সংস্থা থেকে দুর্নীতি বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সংক্রান্ত তথ্য জনগণ পেতে পারে। তথ্য অধিকার আইনানুযায়ী সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তথ্য অধিকার আইনের আওতায় তথ্য দিতে বাধ্য এবং এ আইন ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে তথ্যপ্রাপ্তি সম্ভব। তথ্য অধিকার আইনে বলা হয়েছে, 'কর্তৃপক্ষের নিকট হইতে প্রত্যেক নাগরিকের তথ্য লাভের অধিকার থাকিবে এবং কোন নাগরিকের অনুরোধের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাহাকে তথ্য সরবরাহ করিতে বাধ্য থাকিবে।' এই আইনকে মানুষের কাছে জনপ্রিয় করতে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ এবং সাংবাদিকরা শুরু থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন।
তথ্য অধিকার আইন এবং দুর্নীতি দমন কমিশন অ্যাক্ট উভয়কেই সম্মিলিতভাবে দুর্নীতি দূরীকরণে ব্যবহার করা যায়। দুই আইনেই কমিশনকে নিজস্বভাবে তদন্ত ও অনুসন্ধানের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। দুটি কমিশনই স্বাধীন কিন্তু সাংবিধানিক নয়। ক্ষমতা এবং কার্যক্রমের দিক থেকে তথ্য কমিশন নিজেই তদন্ত করতে পারে এবং আবেদনকারীর চাহিত তথ্য নির্দিষ্ট কার্যদিবসের মধ্যে না পেলে তথ্য কমিশনে অভিযোগ করলে তথ্য কমিশন তা নিষ্পত্তি করতে পারে। অন্যদিকে, দুর্নীতি দমন কমিশনও ক্ষমতা ও কার্যক্রমের দিক থেকে দুর্নীতি সংক্রান্ত তদন্ত ও অনুসন্ধান করতে পারে এবং মামলা দায়ের করতে পারে। তথ্য কমিশনের প্রাত্যহিক কাজের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বিভিন্ন ধরনের সেমিনার এবং ওয়ার্কশপের মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে তথ্য অধিকার আইন সম্পর্কে সচেতন করে তোলা, আইনের প্রয়োগ সম্পর্কে বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক ব্যাখ্যা দেওয়া, ওয়েব পোর্টালে তথ্য হালনাগাদ করা ইত্যাদি। তথ্য অধিকার আইনে বলা হয়েছে, আপিল এবং অভিযোগ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে 'ঈড়ফব ড়ভ ঈরারষ চৎড়পবফঁৎব-১৯০৮' প্রযোজ্য হবে। যেমন_ সমন জারি, কোনো অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তথ্য কমিশনের সামনে উপস্থিত করতে বাধ্য করা, হলফনামার মাধ্যমে প্রমাণ উপস্থাপন করা ইত্যাদি। অপরদিকে, দুর্নীতি দমন কমিশনকে আইনানুযায়ী ঞযব ঈড়ফব ড়ভ ঈৎরসরহধষ চৎড়পবফঁৎব-এর মাধ্যমে সাক্ষী তলব করা, অভিযোগ সম্পর্কে অভিযুক্তকে জেরা করা, বেসরকারি দলিলপত্র উপস্থাপন করা এবং গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪-এ বলা হয়েছে, দুর্নীতি দমন কমিশন অথবা প্রধান দুর্নীতি দমন কমিশনার যে কোনো স্থানে তার ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারবেন এবং দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে পারবেন। দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরও ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে যে, তার অধস্তন যে কোনো অফিসার দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত করতে পারবেন অথবা আইন বা নিয়ম লঙ্ঘন সংক্রান্ত বিষয়ে অনুসন্ধান করতে পারবেন। অন্যদিকে তথ্য অধিকার আইনে উল্লেখ আছে, যদি কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নির্দিষ্ট কার্যদিবসের মধ্যে তথ্য প্রদান না করেন তাহলে অভিযুক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কমিশন ৫০ থেকে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবে। দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪-এ বলা হয়েছে, অবৈধ সম্পদ অর্জনকারী ব্যক্তির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা যাবে। লক্ষণীয়, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন পরিবর্তনের বিলে বলা হয়েছে, বিচারপতি, ম্যাজিস্ট্রেট এবং সরকারি আমলাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ দাখিলের আগে 'দুদক'কে অবশ্যই সরকারের অনুমতি নিতে হবে। তবে 'দুদক' মনে করে, আইনের এহেন পরিবর্তনে 'দুদক' অধিকতর দুর্বল এবং অকার্যকর হয়ে পড়বে এবং সেটা সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে।
তথ্য অধিকার আইন ব্যবহার করে সমাজ থেকে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করা সম্ভব। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে অস্থিরতার সঙ্গে সম্পৃক্ত ১০০ ব্যক্তিকে তদন্ত কমিটি শনাক্ত করেছে। এই অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই রাজনৈতিক বলয় এবং সরকারি উচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। পুঁজিবাজারের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা হতাশ হয়েছেন, যখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, অভিযুক্ত ব্যক্তিবর্গের নাম বাদ দিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। অনেক রাজনীতিক, শিক্ষাবিদ ও প্রশাসনিক ব্যক্তিত্ব উপদেশ দিয়েছেন তথ্য অধিকার আইনকে ব্যবহার করে কীভাবে তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া যায় এবং কী কী ধরনের দুর্নীতি পুঁজিবাজারে ঘটেছে সে সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে। কারণ এখানে ৩৩ লাখ মধ্যবিত্ত বিনিয়োগকারীর জীবন জড়িত। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে তদন্ত প্রতিবেদন আংশিক প্রকাশ করা হবে বলে মতপ্রকাশ করায় ধারণা করা হচ্ছে, সরকার শেয়ার কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের রক্ষার চেষ্টা করছে। দুর্নীতি বিষয়ক তাত্তি্বকদের মতে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দুর্নীতির অন্যতম কারণ হলো, রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার আগে যেসব প্রতিশ্রুতি দেয়, ক্ষমতায় যাওয়ার পর সেগুলো ভুলে যায়। তারা নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতিপরায়ণ কাজে লিপ্ত হয়। তথাপি সরকার পুঁজিবাজারের অস্থিরতা দূরীকরণে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে।
ঐতিহ্যগতভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সরকারি কর্মকর্তারা প্রশাসনিক, অর্থনীতি বিষয়ক কোনো তথ্য দিতে চান না। সরকারি তথ্য জাতীয় সম্পদ_ এই সত্যটি প্রতিষ্ঠায় প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সহযোগিতা প্রয়োজন। জনগণকে যত বেশি তথ্য দেওয়া যাবে, সরকারের দায়িত্বশীলতা ততই বৃদ্ধি পাবে। বিপরীত দিকে যত বেশি তথ্যের সীমাবদ্ধতা থাকবে; সরকারের ক্ষমতা, দায়িত্বশীলতা তত বেশি কমতে থাকবে। তথ্য ছাড়া জনগণ তাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করতে পারে না। যেমন, যখন বাজেট প্রকাশ করা হয় তখন বাজেট প্রণয়ন সংক্রান্ত তথ্যের প্রতি জনগণের অভিগম্যতা থাকা প্রয়োজন।
তথ্য অধিকার আইন চর্চার মাধ্যমে বাংলাদেশে সরকারের জবাবদিহিতা যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি বিভিন্ন বিভাগে দুর্নীতি হ্রাস পাবে। তথ্য কমিশনের প্রথম অভিযোগ দাখিল করে ইঊখঅ (বেলা)। রাজউকের কাছে হাতিরঝিলে বিজিএমইএ ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত রিপোর্ট চাইলে বেলাকে তথ্য দিতে রাজউক অপারগতা প্রকাশ করলে পরে তথ্য কমিশনের হস্তক্ষেপে ইঊখঅ তথ্য পায়। তথ্য কমিশন এ পর্যন্ত চলি্লশটির অধিক অভিযোগ পেয়েছে এবং এর মধ্যে ৩৩টি অভিযোগ নিষ্পত্তি করেছে। অধিকাংশ অভিযোগকারী দরিদ্র মানুষ, যারা তথ্য পেতে ব্যর্থ হয়েছিল। যেমন, সরকার বিনামূল্যে কী কী ওষুধ বিতরণ করে, কৃষির ওপর ভর্তুকির পরিমাণ, ভিজিএফ, ভিজিডি কার্ড বিতরণ ইত্যাদি বিষয়ে। পরিশেষে বলা যায়, তথ্য অধিকার আইন ও দুর্নীতি দমন আইন সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রশাসনিক/বেসরকরি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা বৃদ্ধি এবং দুর্নীতি হ্রাসকরণ সম্ভব।

ড. সাদেকা হালিম : অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং তথ্য কমিশনার
 

No comments

Powered by Blogger.