পরিবেশ-সুন্দরবন বনাম রামপাল তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প by পাভেল পার্থ

মাত্র ২৬৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প বড়, নাকি হাজার বছরের সুন্দরবন? ২১ মার্চ বিশ্ব বন দিবস, ২২ মে আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য দিবস, ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসগুলোর এ বছরের প্রতিপাদ্য বনভূমি। ২০১১ সালকে বিশ্ব বনবর্ষ ঘোষণা করা হয়েছে।


সুন্দরবনকে বাঁচাতে আজই রামপাল তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প বিষয়ে জোরদার সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি


বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ১৯৬২ সাল থেকেই জান ও যৌবন দিয়ে আসছে বাংলাদেশের বনভূমি। উদ্বাস্তু হয়েছে কৃষি, জীবিকা ও জীবনধারা। ১৯৬২ সালে রাঙামাটির কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে গিয়ে রাষ্ট্র ডুবিয়ে দিয়েছে গ্রামের পর গ্রাম, জঙ্গলের পর জঙ্গল, জীবনের পর জীবন। পরবর্তীকালে রাষ্ট্র যখন দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ায় ২৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম কয়লানির্ভর তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে তুলে তখনও রাষ্ট্র জীবন, মাটি, পরিবেশ ও জনজীবনের আহাজারিকে পাত্তা দেয়নি। চলতি লেখাটির বিদ্যুৎবিরোধী হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, লেখাটি বিদ্যুৎ উৎপাদনকে ঘিরে রাষ্ট্রের অধিপতি নীতি ও অপ্রতিবেশীয় দৃষ্টিভঙ্গিকে ঘিরে। কারণ রাষ্ট্র বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে দেশ ও দেশবাসীর কল্যাণে। কিন্তু এসব প্রকল্প ও কর্মসূচি নিয়ে রাষ্ট্র কখনও খোলামেলাভাবে দেশের জনগণের সঙ্গে আলোচনা করে না। সেই ১৯৬২ সাল থেকে শুরু করে হালের রামপাল তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প_ সবখানেই রাষ্ট্র জনগণকে আড়াল করে দূরে সরিয়ে রেখে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মতো 'জনস্বার্থ'গুলো করে যাচ্ছে। যার প্রত্যেকটিই দেশের জল, মাটি, প্রাণবৈচিত্র্য, বনভূমি, আবহাওয়া ও জনজীবনে তৈরি করছে দীর্ঘস্থায়ী বিপর্যয় ও সংঘাত। বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে রাষ্ট্রের এই বেহায়া জনবিচ্ছিন্ন চেহারা-চরিত্র ১৯৬২ সাল থেকে এখনও পাল্টায়নি বা রাষ্ট্র তা পাল্টাতে নারাজ। না কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ, না বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ_ রাষ্ট্র কোনো প্রকল্প থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করেনি বা করতে চায়নি। তাই দেখা যায় গৃহীত প্রতিটি বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পই ব্যর্থ হতে চলেছে এবং জনগণের বিদ্যুৎ সুরক্ষা নিশ্চিত হয়নি। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও প্রতিবেশ ডিসকোর্সকে ঘিরে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রতিবেশীয় রাজনৈতিক অবস্থান এখনও স্পষ্ট নয়। আর রাষ্ট্রের এই অপ্রতিবেশীয় ও অস্পষ্ট অবস্থানই বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বারবার দেশের বনভূমি, জলধারা, কৃষি ও প্রতিবেশের অধিকারকে লঙ্ঘিত করছে।
জল-জঙ্গল-মাটি ও জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে প্রায় ব্যর্থ দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের পর রাষ্ট্র এখন একক আয়তনে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনকে নিশ্চিহ্ন করতে '২৬৪০ মেগাওয়াট রামপাল তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের' কাজ শুরু করেছে। বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার কাটাখালী, সাপমারি ও কৈগরদাসকাঠি মৌজায় প্রস্তাবিত এই তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যেই ১৮৩৪ একর গ্রামীণ কৃষি ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু করেছে। বলা হয়েছে, কয়লা পুড়িয়ে এই প্রকল্পে প্রথম পর্যায়ে ১৩২০ মেগাওয়াট এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে আরও ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এবং ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কোম্পানি (এনটিপিসি) যৌথভাবে এই প্রকল্পের কাজ শুরু করেছে। বিদ্যুৎ প্রকল্পটির প্রায় ৮৭.৫ ভাগ মালিকানাই থাকছে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান এনটিপিসির। 'রামপাল কৃষি জমি রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ' প্রশ্নহীন এই বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছে।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের 'প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকার' মাত্র ৯-১০ কিলোমিটার দূরত্বে এই বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ প্রস্তাবিত হয়েছে। এই প্রকল্পের ফলে কেবল স্থানীয় জনগণ নিজস্ব কৃষি জমি ও ভূমি থেকেই উদ্বাস্তু হবে না, হারিয়ে যাবে উপকূলীয় জীবন-জীবিকার ধারাবাহিকতা। পাশাপাশি এই প্রকল্প মংলা বন্দরের ওপর ফেলবে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিকর প্রভাব। ডাম্পিং এলাকা হিসেবে জয়মণি হয়ে উঠবে আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। সর্বোপরি এই তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প দেশ ও দুনিয়ার সম্পদ ও সম্ভাবনা সুন্দরবনকে দিন দিন গলাটিপে হত্যা করবে। সুন্দরবন তার ম্যানগ্রোভ বাস্তুসংস্থান ও প্রতিবেশীয় ন্যায্যতা হারাতে বাধ্য হবে। জলবায়ু বিপর্যস্ত এই সময়ে বাংলাদেশসহ গোটা দুনিয়া সুন্দবনকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কার্বন-আধার হিসেবে আখ্যায়িত করছে। সুন্দরবন টিকে থাকার সঙ্গে বাংলাদেশ ও পৃথিবীর টিকে থাকার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। কোনোভাবেই ভুলে গেলে চলবে না সিডর ও আইলার মতো দুটি সর্বনাশা বিপর্যয় থেকে সুন্দরবনই নিজের জীবন দিয়ে বাঁচিয়েছে বাংলাদেশকে। সুন্দরবনের কোলে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করে রাষ্ট্র দেশের সবচেয়ে বড় বনভূমির সঙ্গে এমন বেইমানি করতে পারে না।
রাষ্ট্রের পরিবেশ সংক্রান্ত আইন ও নীতিমালায় উল্লেখ আছে, কোনো এলাকায় কোনো ধরনের স্থাপনা বা খনন বা কোনো পরিকল্পনা গ্রহণের আগে অবশ্যই সেই এলাকার প্রাথমিক পরিবেশগত পরীক্ষা এবং পরিবেশগত প্রভাব যাচাই প্রতিবেদন তৈরি করে জনগণের সর্বসম্মতিক্রমে কোনো অনুমতি প্রদান করতে হয়। ওই প্রকল্প গ্রহণের আগে সরকার যদি এসব প্রভাব যাচাই করে থাকে তবে তা অবশ্যই জনসমক্ষে উন্মুক্ত করতে হবে। স্থানীয় জনগণের পূর্বানুমতি ও সিদ্ধান্ত ছাড়া রাষ্ট্র কোনোভাবেই কোনো অন্যায় উন্নয়ন-বাহাদুরি কারও ওপর চাপিয়ে দিতে পারে না। আমরা দেখেছি আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত থেকে সরকার সরে আসতে বাধ্য হয়েছে। বান্দরবানের রুমায় গ্যারিগন সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে, ভাওয়াল শালবনে সাফারি পার্ক প্রকল্পের বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণ আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন। অথচ সরকার বারবার বলছে, প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পই জনস্বার্থে নেওয়া হয়েছে। যদি প্রকল্পগুলো জনস্বার্থেই গৃহীত হয় তবে জনগণের সঙ্গে এসব প্রকল্পের পরিকল্পনা, উদ্দেশ্য, খরচাপাতি এবং দায়িত্ব বিষয়ে সরকারের খোলামেলা আলোচনা করতে সমস্যা কোথায়? যেহেতু রামপাল তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পটি সুন্দরবনের প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকার কাছাকাছি তাই অবশ্যই এক্ষেত্রে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ও পরামর্শ জরুরি।
এক হিসাবে দেখা গেছে, ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বছরে ৩৭ লাখ টন কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গত হয়, যা প্রায় ১৬ কোটি গাছ কেটে ফেলার সমান (িি.িঁপংঁংধ.ড়ৎম)। কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের ফলে মাটি, বায়ু ও জলদূষণ ছাড়াও এখানে বিপুল পরিমাণে ছাই ও বর্জ্য উৎপাদিত হবে, যা রামপালের মতো জনবসতিপূর্ণ এবং সুন্দরবন অঞ্চলে এক দীর্ঘস্থায়ী প্রতিবেশীয় বিপর্যয় তৈরি করবে। সুন্দরবনের পরাগায়ন এবং বন বিস্তারে অনন্য ভূমিকা পালনকারী মৌমাছি ও পাখিদের ওপর পড়বে ক্ষতিকর প্রভাব। এর ফল মধু সংগ্রহকারী মৌয়াল জনগণের ওপরও পড়তে বাধ্য হবে। বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী আইন ২০১০-এর ১৮নং ধারায় স্পষ্ট উলেল্গখ করা হয়েছে, প্রাকৃতিক সংরক্ষিত বনভূমিতে শিল্প কারখানা স্থাপন ও বাণিজ্যিক খনন নিষিদ্ধ। কিন্তু তারপরও কীভাবে সুন্দরবন প্রতিবেশীয় সংকটাপন্ন এলাকায় এ ধরনের বিনাশী বিদ্যুৎ প্রকল্পের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সরকার?
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বাংলাদেশ ভারতীয় প্রতিষ্ঠান এনটিপিসির সঙ্গে ওই বিদ্যুৎ প্রকল্প করতে যাচ্ছে। কিন্তু সেই এনটিপিসির প্রস্তাবিত ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প তার নিজের দেশেই সরকার বাতিল করে দিয়েছে জনস্বার্থ ও প্রতিবেশগত বিবেচনায় (িি.িঃযবযরহফঁ.পড়স, ৮ অক্টোবর, ২০১০)। ভারতের মধ্যপ্রদেশের নরসিংহপুর জেলায় ১০০০ একর কৃষি জমির ওপর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিল এনটিপিসি। যেসব কারণে এনটিপিসি নিজের দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যর্থ হচ্ছে সেসব কারণ ও শর্তকে সেই প্রতিষ্ঠান কী করে আরেকটি দেশে এসে ভঙ্গ করতে চাইছে? মাত্র ২৬৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প বড়, নাকি হাজার বছরের সুন্দরবন? ২১ মার্চ বিশ্ব বন দিবস, ২২ মে আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য দিবস, ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসগুলোর এ বছরের প্রতিপাদ্য বনভূমি। ২০১১ সালকে বিশ্ব বনবর্ষ ঘোষণা করা হয়েছে। সুন্দরবনকে বাঁচাতে আজই রামপাল তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প বিষয়ে জোরদার সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। আশা করি, সরকার দ্রুত শঙ্কিত সুন্দরবনের প্রতিবেশীয় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার ঘোষণা দেবে।
পাভেল পার্থ :গবেষক
animistbangla@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.