চারদিক-রানীরবন্দরে মৈত্রীর মিলনমেলা by এম আর আলম

কবিতা মানে না কাঁটাতার। যখন কোনো কবিতা লেখা হয় তখন তাকে আর দেশের গণ্ডির মধ্যে বেধে রাখা যায় না। হয়ে ওঠে সারা দুনিয়ার মানুষের। নানা দেশের কবিরা পরষ্পরের সখ্য। তাই তো বাংলাদেশ, ভারতের কবিরা একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে আবৃত্তি করলেন শুদ্ধতার আবেশ তাড়িত স্বরচিত কবিতা।


সৈয়দপুর শহরের উপকণ্ঠে দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার রানীরবন্দর নামের একটি গ্রাম। ওই গ্রামে ১৯৩৬ সালে স্থানীয় সাহিত্যের স্বজনেরা গড়ে তুলেছিলেন একটি পাঠাগার। পাঠাগারটি গড়া হয় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের নামে নজরুল পাঠাগার ও ক্লাব। এখানকার নজরুল অনুরাগীরা প্রতিবছরই কবির জন্মদিনকে ঘিরে করে থাকেন নানা আয়োজন। এ কারণে এলাকার সাহিত্যচর্চায় এক ভিন্নতর আবহ সৃষ্টি হয়েছে। ওই পাঠাগারে বসেই নজরুলচর্চা করছে নজরুল সাহিত্য পরিষদ।
নজরুল সাহিত্য পরিষদের সম্পাদক মোখলেছুর রহমান বললেন, ‘আমরা সাহিত্যচর্চা করি এক ধরনের বোধ থেকে। যাতে রয়েছে অন্যের প্রতি মমত্ববোধ, শ্রদ্ধাবোধ, সর্বোপরি দেশাত্ববোধ। সাহিত্যের এ অঙ্গনকে আমরা নাড়া দিতে উদ্যোগী। তাই তো বাংলাদেশ-ভারতের কবিদের নিয়ে এই সাহিত্য আয়োজন।’
রানীরবন্দরে বিশাল মঞ্চে দেখা গেল কবিদের সমাবেশ। ৪ ও ৫ জুনের দুই দিনব্যাপী এ সাহিত্য সম্মিলনীটি ছিল এখানে এক অনন্য অভিজ্ঞতা। বিখ্যাত কবি-বুদ্ধিজীবীর পদভারে অজপাড়াগাঁটি হলো মুখরিত।
কী প্রবল আগ্রহ মানুষের। হাজার পাঁচেক শ্রোতার সমাবেশে সাহিত্য সম্মেলন উদ্বোধন করলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি পদকপ্রাপ্ত নজরুল গবেষক ড. সুশীল ভট্টাচার্য। আকাশে উড়িয়ে দেওয়া হলো শান্তির পায়রা। এরপর দেশজ ব্যঞ্জনার বাদ্যযন্ত্রের লহরি তুলে বের হলো শোভাযাত্রা। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণ দেন জাতীয় সংসদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি আবুল হাসান মাহ্মুদ আলী।
বিশাল মঞ্চে অহমিয়া ভাষায় স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করলেন ভারতীয় কবি গীতা দাস। আসামের কবি নির্মলেন্দু সেনগুপ্ত শোনালেন বাংলা ভাষার কবিতা। একে একে দুই দেশের আড়াই শ কবির আবৃত্তি চলতে থাকল। শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ। মাঝেমধ্যে করতালি।
কথা হলো নজরুল জন্মভূমি বর্ধমানের নজরুল একাডেমির সাবেক সভাপতি সুশীল ভট্টাচার্যের সঙ্গে। তিনি বললেন, বাঙালি চেতনায় জাগরূক সাহিত্য। কখনো কঠিন আবার কখনো প্রবল আবেগপ্রবণ বাঙালি। নজরুল বাঙালি সত্তায় বিদ্রোহের এক চেতনা। তাঁর সাহিত্যে মেলে সাম্যের সমীরণ। নজরুল বলেছেন, ‘গাহি সাম্যের গান—মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’।
ভারত থেকে আসা শতাধিক কবির কণ্ঠে ছিল একই অনুরণন। তাঁরা বললেন, কবি তো বাধা মানে না। কী সুন্দর দুই দেশের এই মিলনমেলা; বাঙালি চিত্তকে বিশাল করে দেয়। আসলে সাহিত্যের এ সুবিশাল জগতে কোনো দেয়াল থাকতে নেই।
সম্মিলনীর তৃতীয় পর্বে সভাপতিত্ব করছিলেন সাহিত্যজন তুষার কান্তি রায়। তিনি বললেন, কাঁটাতারের বেড়ায় হয়তো দুই ভূখণ্ড বিভক্ত। কিন্তু কবির মনে কোনো বিভক্তি নেই। তিনি দুই দেশের বাংলা সাহিত্যচর্চাকে বিকশিত করতে চেয়েছেন, চেয়েছেন মৈত্রীর মেলবন্ধন। অনেক কবি ভিসামুক্ত প্রবেশসুবিধা চাইলেন দুই দেশের সরকারের কাছে। বললেন, এমনটি হলে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হবে।
সাহিত্যে অসাধারণকিছু সৃষ্টি করার অনেক মহৎ প্রতিভা এখানে সুপ্ত আছে। উপমহাদেশে বাঙালিরা প্রেমের পূজারি, যে উপলব্ধি থেকে বিখ্যাত কাব্যগাথা রচনা হতে পারে যেকোনো মুহূর্তে।
সৈয়দপুরের শতবর্ষী সাহিত্যচর্চা প্রতিষ্ঠান শিল্প সাহিত্য সংসদের সভাপতি আমিনুল হক আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সমাপনী পর্বে। তিনি বলেন, ‘আমরা তো হিমালয় ছুঁতে শিখেছি। সাহিত্যাঙ্গনেও আমরা পর্বতচূড়া অতিক্রম করব।’ তিনি বলেন, ‘ভাবের আদান-প্রদান হলো দুই দেশের কবিদের। ভবিষ্যতে এ ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলা সাহিত্য বিশ্বদ্যুতি ছড়াবে, এ বিশ্বাস করতে চাই।’
নজরুলের ১১১তম জন্মবার্ষিকীকে ঘিরে দুই দেশের কবিদের সম্মিলনীর শেষে বিদায় বেলায় অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল প্রাঙ্গণ। নেই বিভেদ, সবাই যেন একই আত্মার বন্ধনে। এপার আর ওপার বাংলার বাঙালিদের লড়াকু মানসিকতার কথা স্মরণ করে বিদায় বেলায় তাই দুই বাংলার কবিরা সমবেত কণ্ঠে গাইলেন ‘শেকল পড়া ছল মোদের এই শেকল পড়া ছল’। তারপর ওই শেকল দিয়েই অনেক কিছু বিকল করে দেওয়ার শপথ গর্জে উঠল কবিদের কণ্ঠে।

No comments

Powered by Blogger.