অভিমত-ঋণের জামানত হোক সততা ও নৈতিকতা by চৌধুরী মনজুর লিয়াকত

লতিফুর রহমানের ব্যবসার স্বীকৃতির বিষয়ে একটি প্রতিবেদন পড়ছিলাম প্রথম আলোর শনিবারের ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’। নরওয়ের অসলোতে বিজনেস ফর পিস ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ২০০৭ সালে। ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি) এই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম সহযোগী অংশীদার।
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রতিষ্ঠানটি বিজনেস ফর পিস অ্যাওয়ার্ড দিয়ে আসছে। পুরস্কারের জুরি বোর্ডে থাকেন অর্থনীতি ও শান্তিতে নোবেল বিজয়ীরা। এই প্রতিষ্ঠান বিশ্বাস করে, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও নৈতিকতার উদ্যোগ শুধু নিজের কাজ জাহির করার জন্য হতে পারে না, ব্যবসার ক্ষেত্রেও এটা থাকতে হবে, যা ক্রমাগতভাবে প্রতিষ্ঠানটির অভ্যাসের সংস্কৃতিতে পরিণত হতে হবে এবং আধুনিক ব্যবসার একটা অপরিহার্য অংশ হিসেবে আইনে পরিণত করতে হবে।
২০১২ সালের ৭ মে ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে নীতি-নৈতিকতা, সুনাম আর সততার স্বীকৃতি হিসেবে ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান পেয়েছেন বিজনেস ফর পিস অ্যাওয়ার্ড। এই পুরস্কার ইতিমধ্যে পৃথিবীতে অন্য অর্থে ব্যবসা-বাণিজ্যের নোবেল পুরস্কারের সমতুল্যতা অর্জন করেছে। যাঁরা ব্যবসার নীতি-নৈতিকতা মানেন, সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা ভাবেন, মনে রাখেন শ্রমিক ও কর্মচারীদের কল্যাণের কথা আর যাঁদের রয়েছে পরিবেশ নিয়ে সচেতনতা—তাঁদের জন্যই এ পুরস্কার।
লতিফুর রহমানের পুরস্কারের মূল্যায়নে কমিটি যেটা বলেছে, সেটার ভাবার্থ করলে দাঁড়ায়, দেশের একটি অন্যতম শীর্ষস্থানীয় করপোরেট প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও সিইও লতিফুর রহমান। দায়িত্বশীলতা ও নৈতিকতার জন্য এই প্রতিষ্ঠান এ অঞ্চলে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে অনুসরণীয় করপোরেট প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজের অবস্থান করে নিয়েছে। সরকারকে সর্বোচ্চ পরিমাণের কর, ভ্যাট, আমদানি-শুল্ক দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম এই প্রতিষ্ঠান। শ্রম মানদণ্ড ও শিল্প আইন মেনে চলার ক্ষেত্রেও ট্রান্সকম গ্রুপের দারুণ সুনাম। এ অঞ্চলে ব্যবসার ক্ষেত্রে লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে সততা, নৈতিক দৃঢ়তা ও বিচক্ষণতা অনুসরণযোগ্য; পাশাপাশি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই গ্রুপের পরিচ্ছন্ন ব্যাংকিং লেনদেনের বিষয়টিও যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে।
পুরস্কার নিয়ে লতিফুর রহমান কিছু কথা বলেছিলেন, যার সারসংক্ষেপ অনেকটা এ রকম: নরওয়েসহ অনেক উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য কল্যাণমূলক সুযোগ-সুবিধা নেই, তাই কল্যাণের কথা মনে রেখেই নিয়োগকর্তা বা মালিকদের শিল্প ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং বিকশিত করা উচিত। তিনি বলেছেন, প্রত্যেক মা-বাবাই তাঁদের সন্তানদের সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ মেনে চলার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তাই যতক্ষণ কেউ মূল্যবোধ পালনের বিষয়ে সতর্ক থাকেন এবং চর্চা করে চলেন, ততক্ষণ পর্যন্ত সামাজিক দায়িত্বশীলতা ও নৈতিকতার সঙ্গে ব্যবসা করে যাওয়াটা তাঁর দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অংশ হয়ে থাকবে। এক প্রশ্নের উত্তরে খোলামেলাভাবে এবং খুব সাহসের সঙ্গে তাঁর সৎ স্বীকারোক্তি ছিল, ভারী ভারী কথায় তিনি বিশ্বাস করেন না। তিনি কোনো মহান উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যবসা করছেন, এ ধরনের কথা বলেন না; বরং তিনি বলেন, ব্যবসা করছেন নিজের জন্য, কিন্তু সেটা করছেন নীতি ও নৈতিকতা মেনে। এর মাধ্যমে সমাজ বা দেশের যদি কোনো উপকার হয়, তাহলে সেটিই বড় অর্জন।
অন্য একটি জায়গায় তিনি বলেছেন, পারিবারিক মূল্যবোধ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আস্থা রাখতে হবে দেশের ওপর। অনেক সম্ভাবনা আছে এখানে। যদি রাজনৈতিক বিরোধ না থাকত, তাহলে আরও অনেক দূর এগোতে পারত বাংলাদেশ। তাঁর বিশ্বাস, রাজনৈতিক এই সংঘাত সব সময় থাকবে না। সময়ের পরিক্রমায় এগুলো চলে যাবে, তাঁর আস্থা রাখার যে জায়গা, সেই তরুণেরা এগিয়ে আসছে। এই প্রত্যয়ী তরুণ প্রজন্ম বাংলাদেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে, এটাই তিনি মনে করেন। তিনি চান, তাঁর প্রতিষ্ঠান টিকে থাকুক ১০০ বছর পার করেও। সঠিক ব্যক্তিকে সঠিক স্থানে বসিয়ে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে বিশ্বমানের ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে।
এই প্রতিবেদনের এক জায়গায় ১৯৭৪ সালে তাঁর ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার ঘটনাটি পড়তে গিয়ে দেখলাম, হঠাৎ করে তাঁদের এক শূন্য অবস্থার সৃষ্টি হয়। তখন তাঁর হাতে নগদ টাকা ছিল না। একটি ব্যবসা করার জন্য তাঁর ঋণের দরকার হলো। তিনি ব্যাংকে গিয়ে নেদারল্যান্ড থেকে চা আমদানির জন্য আবেদন করে তা ব্যাংক ব্যবস্থাপকের মাধ্যমে পেয়েও গেলেন। কিন্তু ব্যাংকে ২০ শতাংশ মার্জিন লাগবে। এ টাকা তাঁর ছিল না। এ ব্যাপারে তিনি ব্যাংকের এমডির কাছে আবেদন করলেন। এমডি তাঁকে মার্জিন ছাড়াই ঋণ দিলেন। প্রায় ১৪ বছর পর যখন তিনি প্রতিষ্ঠিত এক ব্যবসায়ী, তখন এই ব্যাংকারের সঙ্গে দেখা হয় এক জায়গায়। তিনি তাঁকে তখন বললেন, তাঁর প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হওয়ার পেছনে যা অর্জন, তা ওই ব্যাংকের তখনকার সহযোগিতার জন্যই সম্ভব হয়েছে। কোনো মার্জিন ছাড়াই লোনের এই সিদ্ধান্ত যেহেতু সেই ব্যাংকার নিয়েছিলেন, তাই তিনিই এ ব্যাপারে কৃতজ্ঞতা পেতে পারেন। কেন তিনি সেটা নিয়েছিলেন—এ প্রশ্ন করেন লতিফুর রহমান তাঁকে। কারণ, এভাবে শূন্য মার্জিনে কোনো ঋণ নেওয়া যায় না। তখন ওই এমডির উত্তর ছিল, তিনি লতিফুর রহমানের বাবাকে চিনতেন এবং তাঁর সুনাম, ব্যাংক লেনদেনে স্বচ্ছতা ও নৈতিকতার কথা জানতেন। সেই বাবার ছেলে বলেই তাঁকে বিশেষ সুযোগটি দিয়েছিলেন। ওই ব্যাংকার তখন আরও বলেছিলেন, লতিফুর রহমানের প্রতি যে আস্থা তিনি রেখেছিলেন, তার প্রতিদান তিনি দিয়েছেন ওই সততা ও নৈতিকতার ভিত্তিতে সাফল্য অর্জন করে এবং ব্যাংক লোনের যথাযথ পরিশোধের মাধ্যমে। এখন যদি তাঁর ছেলেও ওই ব্যাংকারের কাছে যায়, তবে তাকেও তিনি এভাবেই ঋণ দেবেন। আর সেই ঋণের জামানত, ইকুইটি, মার্জিন, কোলেটারাল হবে সততা, নৈতিকতা, সুনাম ও ব্যাংক লেনদেনে স্বচ্ছতা। এখানে বৈষয়িক কোনো সম্পদের প্রয়োজন পড়বে না।
ব্যবসায়ীর উত্থান এবং ব্যাংকের সমর্থন—এ দুই ক্ষেত্রে যখন ‘নীতি-নৈতিকতা’ ও ‘সততা’ কাজ করে, তখন সত্যিকার অর্থে কোনো সাফল্য ও উন্নয়নকে থামিয়ে রাখা যায় না। এ সাফল্য ও পুরস্কার সেটাই প্রমাণ করেছে।
আজকের ব্যবসা ও ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় রেগুলেটরি নানা বিধি-বিধান দিনে দিনে জোরদার করা হচ্ছে। কারণ, ব্যবসা-বাণিজ্য নীতি-নির্ভরতার বাইরে চলে যাচ্ছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। সেখানে লতিফুর রহমানের এই পুরস্কার অর্জন আমাদের নিশ্চয়ই অনুপ্রাণিত করতে পারে নতুনভাবে। এক দিন নিশ্চয়ই ব্যাংকের কোলেটারাল, মার্জিন, ইকুইটির স্থানে সব ব্যবসায়িক প্রয়োজন মিটবে শুধু বিশ্বাস, নৈতিকতা ও সততা ঘিরেই। একজন ব্যাংকার হিসেবে আমি সে প্রত্যাশাই করি।
চৌধুরী মনজুর লিয়াকত: ব্যাংকার।

No comments

Powered by Blogger.