চরাচর-জয়দেবপুর সশস্ত্র প্রতিরোধ দিবস by তাপস রায়

রাজধানী ঢাকার পাশেই শান্ত, ছোট্ট ছিমছাম শহর জয়দেবপুর। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পাতায় জয়দেবপুরের নাম লেখা হয় গৌরবের কালিতে। মুক্তির আকুলতা নিয়ে অকুতোভয়দের সেই মিছিলে জয়দেবপুরের মানুষও সেদিন শামিল হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মিছিলের অগ্রভাগেই ছিল তাদের নাম।


জয়দেবপুরের চান্দনা চৌরাস্তায় স্থাপিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ভাস্কর্য 'জাগ্রত চৌরঙ্গী' এ কথার সাক্ষ্য দেয়। তৎকালীন জয়দেবপুরের ভাওয়াল রাজবাড়ী ছিল ১৭ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের দপ্তর এবং ব্যারাক। এই ব্যারাকে বাঙালি সৈন্য বেশি ছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সেই উত্তাল দিনগুলোয় ঢাকা থেকে আসা নির্দেশ অনুযায়ী দেশের অন্য জায়গাগুলোর মতো জয়দেবপুরেও বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হচ্ছিল। হানাদারদের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে মিছিলে-মিছিলে, স্লোগানে-স্লোগানে মুখরিত ছিল জয়দেবপুর। মুক্তিযুদ্ধের জন্য তখন এ এলাকায় গঠিত হয় ভাওয়াল স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদ। সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন আ ক ম মোজাম্মেল হক। বর্তমানে তিনি পার্লামেন্ট মেম্বার। এর সদস্য ছিলেন হারুন উর রশীদ, শহীদুল্লাহ বাচ্চু, হজরত আলী, জিন্নাহ পাঠান, মো. আবু সাত্তার মিয়া ও নজরুল ইসলাম। হাইকমান্ডের সদস্য ছিলেন মো. হাবীবুল্লাহ, এম এ মোত্তালিব ও ডা. মনীন্দ্রনাথ গোস্বামী। তাঁদের মধ্যে অনেকেই প্রয়াত। তাঁদের অপ্রতিরোধ্য মনোবলে বিক্ষোভ ফুঁসে উঠেছিল। সর্বস্তরের সব পেশার মানুষ শামিল হয়েছিল সেই বিক্ষোভে। এরই মধ্যে ১৭ মার্চ লুট হলো সমরাস্ত্র কারখানার অস্ত্রভাণ্ডার। টনক নড়ল পাকিস্তানি সামরিক জান্তার। ১৯ মার্চ ঢাকা থেকে বিপুলসংখ্যক পাকিস্তানি সেনা পাঠানো হলো জয়দেবপুর সেনানিবাসের দিকে। কারণ স্থানীয় মুক্তিকামী মানুষেরা যেভাবে ফুঁসে উঠেছিল, তাদের সঙ্গে সেনানিবাসের বাঙালি সৈনিকেরা যোগ দিয়ে যাতে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারে_সে জন্য আগেই বাঙালি সৈনিকদের নিরস্ত্র করে অস্ত্রশস্ত্র নিজেদের কবজায় নিয়ে নেওয়া। কিন্তু বিধিবাম! এ খবর বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। মুহূর্তেই একত্রিত হলো সাধারণ মানুষ। তাদের কণ্ঠে স্লোগান, হৃদয়ে শপথ_যেভাবেই হোক রুখে দিতে হবে পাকিস্তানি সেনাদের। অস্ত্র নিয়ে তাদের ফিরে যেতে দেওয়া হবে না। দিনটি ছিল শুক্রবার। হাটের দিন। ব্যবসা ফেলে ছুটে এল হাটের ব্যবসায়ী। কারখানা বন্ধ করে এল শ্রমিক। মাঠে লাঙল ফেলে কাস্তে হাতে এল কৃষক। সাধারণ মানুষ যে যা পেল, তা নিয়ে এগিয়ে এল মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধে অংশ নিতে। তাদের কারো হাতে ইট-পাথর। কারো হাতে বাঁশের লাঠি, লগি। কেউ বিভিন্ন ভবনের ছাদে উঠে গেল শখের একনালা বন্দুক নিয়ে। উদ্দেশ্য সবারই এক_যে করেই হোক হটিয়ে দিতে হবে পাকিস্তানি সেনাদের। রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে ব্যারিকেড দেওয়া হলো। ফলে পাকিস্তানি সেনারা বাধাপ্রাপ্ত হতেই গুলি ছুড়তে শুরু করল। গুলিতে নিহত হলো হুরমত, নিয়ামত, মনু খলিফাসহ আরো অনেকে। বেরিকেড ভেঙে পাকিস্তানি সেনারা এগিয়ে যেতে থাকল জয়দেবপুর চৌরাস্তার দিকে। এখানেও শত শত মানুষের প্রতিরোধের মুখে পড়ল সেনারা। চলল গুলি। তারা অমানবিক অত্যাচার চালাল বিক্ষোভকারীদের ওপর। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলল পাকিস্তানি সেনাদের তাণ্ডবলীলা। তারপর তারা ফিরে গেল ঢাকার দিকে। জয়দেবপুরে ঘটে যাওয়া সেদিনের সেই ঘটনার রেশ স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ল দেশজুড়ে। 'জয়দেবপুরের পথ ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো' স্লোগানে-স্লোগানে মুখরিত হলো দেশ।

No comments

Powered by Blogger.