পাকিস্তান শেষ কার্ডও খেলেছে by মোহাম্মদ তাকী

ন্যাটো সরবরাহে পাকিস্তানের অবরোধ আরোপ অনেকটা রাস্তায় শিশু-কিশোরদের ক্রিকেট খেলার মতো। সেখানে দেখা যায়, একজন ছেলে হয়তো বল বা ব্যাটের মালিক। খেলার ফলাফল ওর পছন্দ না হলে সে সেখান থেকে তার বল বা ব্যাট নিয়ে চলে যেতে পারে অবলীলায়।


ভাবখানা এই, দেখি তোমরা আমার বল বা ব্যাট ছাড়া কী করে খেলা খেলতে পার! রাস্তার খেলায় অবশ্য কখনও কখনও এ ধরনের আবদার চলতে পারে। কিন্তু সেখানেও বাদবাকি খেলোয়াড়রা তাৎক্ষণিকভাবে বিকল্প ব্যবস্থা করে ফেললে এ ধরনের কৌশলে কাজ দেয় না। আফগানিস্তানে ন্যাটো সরবরাহের দুই-তৃতীয়াংশের মতো পাকিস্তানের রুট ব্যবহার করেই সম্পন্ন হচ্ছিল। তবে রুটটা সস্তাও নয়। আমার কাছে ন্যাটোর একজন শীর্ষস্থানীয় সরবরাহকারী বলেছেন, এক বোতল পানির দাম যেখানে ফ্লোরিডায় ৫০ সেন্টের মতো পড়ে, সেখানে পাকিস্তানি রুট ব্যবহার করে ওই পানি আফগানিস্তান পর্যন্ত পেঁৗছতে এর দাম উঠে আট ডলারের মতো। পাকিস্তান এই নেটওয়ার্ক যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অপরিহার্য মনে করে রাস্তার ছেলেদের ক্রিকেট খেলার মতো আচরণ করছে।
তবে শিকাগোতে অনুষ্ঠিত ন্যাটোর শীর্ষ বৈঠক পাকিস্তানের অপরিহার্যতার তত্ত্বকে অসার প্রমাণ করেছে। ন্যাটো এখন লাতভিয়া থেকে রাশিয়া, কাজাখস্তান, উজবেকিস্তানের ভেতর দিয়ে কিরঘিস্তানের বিশেখ ও তাজিকিস্তান হয়ে সড়ক রুটটি বেশি করে ব্যবহার করতে চাইছে। এখানে তুরস্ক হয়ে এবং জর্জিয়ার কৃষ্ণসাগর বন্দর সুবিধা ব্যবহারেরও সুযোগ রয়েছে। এই রুটটি দীর্ঘ; কিন্তু নিরাপদ বিকল্প। পাকিস্তান তার ভেতর দিয়ে ন্যাটো সরবরাহ পেঁৗছানোর পথকে বিকল্পহীন মনে করে নীতি প্রণয়নে বড় রকমের ভুল করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য বিকল্প কার্ড তার হাতে আর নেই।
শিকাগো বৈঠক পর্যন্ত পাকিস্তানি সার্কেলের এই চিন্তা বিভ্রম বজায় থাকাটা সত্যিই বিস্ময়ের। ন্যাটো শীর্ষ বৈঠকের কয়েকদিন আগে নাসিম জেহরা ফরেন পলিসি আফপাক চ্যানেলে লেখেন : প্রথমত, শিকাগো বৈঠকের প্রাক্কালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারির সঙ্গে বৈঠকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাৎক্ষণিক ক্ষমা চাইবেন। দ্বিতীয়ত, পরিকল্পিত গোয়েন্দা বিমান হামলার আগে যুক্তরাষ্ট্র তাদের হামলার টার্গেট, কী কারণে হামলা চালানো হবে, কোন এলাকায় হামলা চালানো হবে, হামলার সংখ্যা কত হবে_ ইত্যাকার বিষয় পাকিস্তান কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবে। তৃতীয়ত, পাকিস্তানি সরবরাহ রুট ব্যবহারের ফি নির্ধারণের ব্যাপারে উভয়পক্ষ অধিকতর গ্রহণযোগ্য অর্থ ধার্যে একমত হবে। চতুর্থত, সালালার মতো আর কোনো ঘটনা ঘটবে না এটা ন্যাটোকে নিশ্চয়তা দিতে হবে। এটা একজন প্রধান শিক্ষিকার তার ছাত্রদের সংশোধনের উদ্দেশ্যে শাস্তি দেওয়ার মতো মনে হয় না!
সত্যিকথা বলতে কি, পাকিস্তানের অধিকাংশ বিশ্লেষক ও যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত কূটনীতিক তাদের চাহিদাপত্র প্রস্তুত করার ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সত্যিকার মনোভাব কী তা অনুধাবন করতে পারেননি। বিষয়টা এমন নয় যে, একবার ভুল হয়ে গেছে, এবারের মতো মাফ করে দিন আর ভুল হবে না_ এমনটা বললেই সব সংকটের অবসান ঘটে যাবে। এ ক্ষেত্রে ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্রের জবাবটা সাদামাটা হতে পারে। তারা পাকিস্তানি বিতরণ রুটকে বাদ দিয়ে ব্যয়বহুল রুট ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। পাকিস্তানি রুট ব্যবহার করতে গেলে তাদের অর্থ গুনলেই চলবে না, এর জন্য ক্ষমা ভিক্ষাও করতে হবে। আর বিকল্প রুট ব্যবহার করলে ক্ষমা-ঘেন্না কিছুই নেই, বাড়তি কিছু অর্থ লাগবে এই যা। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এবং তার উপদেষ্টামণ্ডলী সেই পুরনো ধ্যান-ধারণা এখনও লালন করে চলেছেন। কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যেন বলেছিলেন, পাকিস্তানের যুক্তরাষ্ট্রকে যতটা প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তানকে প্রয়োজন। তিনি সাংবাদিক/ফটোগ্রাফার মার্গারেট বুরকি-হোয়াইটকে আরও বলেছিলেন, পাকিস্তান বিশ্বের একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা... এখান থেকে রাশিয়া খুব দূরে নয়। আর যুক্তরাষ্ট্রের এখন উত্থান ঘটছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন যেমন গ্রিস ও তুরস্ককে শক্তিআলী করার জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার ঢালছে, তেমনি একটা সময় আসবে যখন পাকিস্তানে অস্ত্র ও অর্থ সাহায্য দিতে তারা এগিয়ে আসবে। পাকিস্তানি চিন্তাধারায় দীর্ঘ ৬৫ বছরেও তেমন পরিবর্তন আসেনি। তবে যেটা পরিবর্তন হয়েছে সেটা হলো, পাকিস্তান এখন আর ভূরাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে নেই।

ড. মোহাম্মদ তাকীর লেখাটি আউটলুক থেকে ভাষান্তর করেছেন সুভাষ সাহা
 

No comments

Powered by Blogger.