একদিন অন্য জগতে by সুরাইয়া জাফর

টাঙ্গাইল নিষিদ্ধ পল্লীটা অনেকটা জায়গাজুড়ে গোলাকৃতি আকারে অনেক ছোট-বড় টিনের ঘর নিয়ে বিস্তৃত। গলির মুখে ঢোকার সময়ই হঠাৎ করে আমার চোখ আটকে গেল বেশ কয়েকটি অতিরিক্ত মেকআপ করা মেয়ের ওপর। এরা বিভিন্ন ভঙ্গিতে অনেকটা সিনেমার নায়িকাদের মতো ভাব নিয়ে কয়েকজন দাঁড়িয়ে এবং কয়েকজন বসেছিল।
এদের ভাবভঙ্গি দেখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল এরা কারও অপেক্ষায় উন্মুখ হয়ে আছে। এদের বয়সও বিভিন্ন রকম_ ১৪-৩৫ এর মধ্যে হবে হয়তোবা। আমরা সরু গলি দিয়ে কিছুটা পথ পেরিয়ে একটি টিনের ঘরের ভেতর ঢুকলাম। সেখানে আগে থেকেই আমাদের জন্য গোল করে রুমের চারদিক ঘিরে চেয়ার রেখে দেওয়া ছিল। ৩ ভারতীয়সহ ঢাকা থেকে যাওয়া আমরা ৫ জন এবং আমাদের স্থানীয় সহযোগী বসতে না বসতেই হুড়মুড় করে বেশকিছু অল্প বয়সী মেয়ে এবং মাঝ বয়সী মহিলাও ঢুকে আসন গ্রহণ করল। এরা নিজেদের মধ্যে ইতিমধ্যে ফিসফাস করে আমাদের নিয়ে কিছু বলছিল। ইউএন কর্মীদের মধ্যে লিডার হয়ে অনিন্দিত (ভারতীয় নাগরিক) পরিষ্কার বাংলায় এ যৌনকর্মীদের বসতে আহ্বান করে জানিয়ে দিল সে তার সঙ্গীদের নিয়ে (ইউএন কর্মীরা) এখানে তাদের জীবনযাত্রা উন্নততর করার উদ্দেশ্যে কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে এসেছে। ১ মিনিট পার হলো, এরপর একজন দাঁড়িয়ে রোজী বলে নিজেকে পরিচয় দিল এবং 'নারীমুক্তি' সংঘের সভাপতি হিসেবে এ যৌনপল্লীতে কাজ করে তাও জানাল। রোজীর কাছ থেকেই জানা গেল এই 'নারীমুক্তি' সংঘটি কেয়ার বাংলাদেশ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এবং এ সংঘের মেম্বার প্রায় সবাই যৌনকর্মী। এদের মধ্যে মর্জিনা দাঁড়িয়ে নিজের পরিচয় দিল 'নারীমুক্তি'র জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে। তারপর রোকসানা নামে এক মধ্যবয়সী নারী নিজেকে এর সদস্য বলে পরিচয় দিল। এরা সবাই খুব মনোযোগ সহকারে অনিন্দিত-হোমায়রার সব প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিল। এ সময় হোমায়রা এবং অনিন্দিত বলল, ওদের প্রতিটি ঘরে গিয়ে বাস্তব জীবনের কিছু ছবি তোলা দরকার। যে ক্যামেরা নিয়ে তৈরি তার নাম আশুতোষ। দিলি্ল থেকে ইউএনের কাজেই তিনি ঢাকায় এসেছেন। এই ইউএন কর্মীরা ঘরটা ছেড়ে ছবি তোলার কাজে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে পুরো ঘর মুহূর্তে খালি হয়ে গেল। আমি এক নজর চোখ বুলালাম ঘরটা দেখতে। দেখলাম এক কোনায় ১০-১২টি সেলাই মেশিন ধুলাবালুতে ভরে আছে। ঘরের মধ্যে রোকসানা, যে কি-না নারীমুক্তির সদস্য এবং এক সময়কার ডাকসাইটে যৌনকর্মী। সে বসেছিল একা আমার সঙ্গে। আমি এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করলাম না। রোকসানাকে বললাম, 'এখন কেউই ঘরে নেই আমি ছাড়া, আমার কাছে যদি প্রাণ খুলে আপনার জীবন সম্পর্কে বলেন তাহলে আমার বড্ড সুবিধা হবে আপনাদের নিয়ে কিছু লিখতে। সেও খুব উৎসাহ নিয়ে নিজের জীবনের করুণ কাহিনী আমাকে অনর্গল বলে গেল। রোকসানা খুব ছোটবেলায় (প্রায় ১২ বছর) এ নিষিদ্ধ পল্লীতে একটি দুর্ঘটনার শিকার হয়ে এসেছিল। ও থাকত ওর মায়ের সঙ্গে টাঙ্গাইলের কোনো এক বস্তিতে। মাকে প্রতিদিন সকালবেলায় ঠিকে ঝিয়ের কাজে বেরিয়ে পড়তে হতো। একদিন এক রিকশাওয়ালা রোকসানাকে একা ঘরে পেয়ে ধর্ষণ করে এই নিষিদ্ধ পল্লীতে এনে বিক্রি করে দিয়েছিল। সে এখন 'নারীমুক্তি' সংঘের সদস্য হয়ে এখানকার যৌনকর্মীদের অধিকার সংরক্ষণের কাজ করছে।
এর মধ্যে ফের সবাই ফিরে এসেছে। আমরা গান শোনানো নিয়ে চাপাচাপি করতেই দু'তিনজন সুর করে গান ধরল। গানের কথাগুলো সঠিক মনে নেই। তবে ওদের সুরগুলো দুঃখ ভারাক্রান্ত ছিল। এমনকি এরা যখন কথা বলে তখনও একটা চাপা কান্না ভেতরে বাস করছে_ এটা বোঝা যায়। ফেরার সময় ওরা আমাদের অনুরোধ জানাল, একদিন সময় করে যেন ওদের সঙ্গে দুপুরের খাবার খাই। আমি বললাম, সম্ভব হলে একদিন অবশ্যই এসে যাব, পরখ করব ওদের মজাদার খাবার; কিন্তু আমি নিজেই জানি এই 'সম্ভব'টা কতটুকু অসম্ভব আমার জন্য। পুত্রবধূর বদৌলতে আসতে পেরেছি এদের দেখতে, বাড়িতে যখন জানবে কোথায় গিয়েছিলাম, তখন হয়তোবা অনেক কটু প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। তবে এ যৌনকর্মীদের দেখার পর থেকে এদের জন্য আমার মনটা বিষণ্ন হয়ে আছে। মাথায় শুধু ঘুরছে এদের জীবনযাত্রা বদলানোর উপায় কী? আমাদের সরকার কি অন্য ধরনের কর্মসংস্থান করে দিয়ে এ জঘন্য জীবন থেকে এদের উদ্ধার করতে পারে না? এদের শিশুরা নোংরা পরিবেশ থেকে দূরে থাকতে পারছে না এবং অন্যান্য বিপদের সম্মুখীনও হচ্ছে। আমি অনুভব করেছি এদের একজন কাউন্সিলর ভীষণ দরকার। এই কাউন্সিলর সময়মতো এদের মানসিক শক্তি বৃদ্ধি করে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতে সাহায্য করতে পারে। দেহ বিক্রি কেন? অদম্য ইচ্ছা থাকলেই একজন নারী অন্য যে কোনো ধরনের কাজ করে নিজের সম্মান রক্ষা করে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন চালাতে পারে বলেই আমার বিশ্বাস। এই প্রচণ্ড বিশ্বাস নিয়েই লিখছি যে, এই যৌনকর্মীদের সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিতে সরকার কিছু পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করে সমাজে একটা বিপ্লব ঘটাতে পারে। শুরুতে অর্থনৈতিক সাহায্য দিয়ে ওদের কিছু একটা করার ক্ষমতায়ন করা দরকার। পরবর্তী সময়ে তাদের কুটির শিল্প এবং অন্যান্য শিল্পের কাজে প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মক্ষম করে তোলা। তাদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা এবং কর্ম সম্পর্কে উৎসাহ-উদ্দীপনা বাড়ানোর জন্য স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ করা। সর্বোপরি একটি পর্যবেক্ষণ বা মনিটরিং কমিটি গঠন করে এদের প্রতিদিনকার জীবনপ্রণালির খোঁজ রাখা।
 

No comments

Powered by Blogger.