গোধূলির ছায়াপথে-ভৌগোলিক বিজয় ও আধ্যাত্মিক যাত্রা by মুস্তাফা জামান আব্বাসী

ফেসবুকের নাম দিয়েছি ‘চন্দ্রমুখ’। প্রোফাইলে সামান্য পরিচিতি। বন্ধুত্বকামীরা ‘চন্দ্রমুখ’-এ ভাসিয়ে চলেছেন কাগজের নৌকো। ‘চন্দ্রমুখ’ খুলে দেওয়া হলে ফেসবুক টিম জানিয়েছে, ইতিমধ্যে অপেক্ষমাণ ৭৮৭ বন্ধুত্বকামী। অস্ট্রেলিয়া, পাপুয়া নিউগিনি, জাপান, বলিভিয়া, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, আমেরিকার বড় শহর, ভিয়েনা, মস্কো ও ভারতে আমার বন্ধুদের ঘর।
বিটিভিতে ভরা নদীর বাঁকে উপস্থাপনা করি যখন, চিঠি পেয়েছিলাম ২৫ হাজার। চিঠি লেখার দিন আর নেই। আজ সেখানে ই-মেইল, ‘চন্দ্রমুখ’। ভালো লাগা আর না লাগার কত অনুভূতি তার বারতায়।
মার্কিন প্রবাসী বড় মেয়ে সামিরা কয়দিনের জন্য ঢাকায় বেড়াতে এসেছে। বাড়ি গুলজার গানে, কবিতায়, রান্নার সুগন্ধে। কন্যা কবিতা লেখেন, ভক্ত তার, আমেরিকায়, পশ্চিম বাংলায়। বললাম, কটা দিন সবুর কর, রসুন বুনেছি। ‘এভারেস্ট-চূড়ায় মুসার পতাকা’ তোমার লেখা কবিতাটি পৌঁছে যাবে শিগগিরই ‘চন্দ্রমুখ’-এ। বন্ধ করে রাখা তারুণ্যকে বিনা কারণে প্রহার।
আলভি ছুটে এসে কোলে চড়ে জানাল মুসা ইব্রাহীমের বিজয়ের খবর। পাঁচ বছরের নাতিকে দুই গালে দিলাম দুটো চুমু। এটা ছিল মুসার প্রাপ্য। আলভি বায়না দিল, এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার জন্য ‘ট্রাক স্যুট’ কিনে দিতে হবে আজই। সে যাবে অচিরেই কাঠমান্ডুর ‘ইয়েতি হোটেলে’ রক্ষিত তুষারমানব ‘ইয়েতি ও ইয়াক’-এর পদযুগলের সন্ধানে। এটি তার স্বপ্ন। স্মৃতির পর্দায় ভেসে উঠল তেনজিং নোরগের কথা, যাঁর বাসায় গিয়ে চা খেয়েছি, ছবি তুলেছি, দার্জিলিংয়ে তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে সময় কাটিয়েছি ২৫-৩০ বছর আগে। ঢাকা রোটারি ক্লাবের সভায় স্যার এডমন্ড হিলারির চমৎকার বক্তৃতার কথা মনে পড়ল, যেন মুহূর্তে পৌঁছে যাই দুয়ার থেকে অদূরে, কুচবিহারের চা-বাগান পেরোলেই এভারেস্টের চূড়ায়। সন্তানতুল্য মুসা ইব্রাহীম বাঙালিদের মুখোজ্জ্বল করেছেন। রাধানাথ শিকদারের সঙ্গে তাঁর নাম অক্ষয় হয়ে রইল ইতিহাসের পাতায়। পর্বতের উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন মুসা। ভৌগোলিক উচ্চতা ও আধ্যাত্মিক উচ্চতা দুটোর সমন্বয় যাঁরা করেছেন, সেই সাধু-সন্ন্যাসীদের পেছনে মন ছুটে গিয়েছিল সেদিন থেকে, আজও তাঁদের পেছনেই।
বাঙালির মননে শিহরণ জাগানোর মতো ঘটনা প্রতিদিন আসে না। ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করেছিলেন ব্রজেন দাস, আবার যেদিন আবদুল মালেক চ্যানেল সাঁতার দেন মেঘনার ইলিশের মতো, সেদিনও রক্তে আনন্দের শিহরণ। ক্রিকেটে পাকিস্তানকে পরাস্ত করে বাংলার দামাল ক্রিকেটাররা, সেদিন রাতে ঘুমুতে পারিনি। প্রফেসর ইউনূস নোবেল পেলেন, পুরো পরিবার সেদিন জায়নামাজে।
ওই যে বললাম, আধ্যাত্মিক উচ্চতা। মাটির আকর্ষণ ছাড়িয়ে আরেকটু ওপরে ওঠা। ভালো লাগে গ্রামের নদীটির প্রবাহিত জলরাশি, যেখানে দুই দণ্ড নদীর পানিতে পা ডুবিয়ে রাখলে খুঁজে পাই মনের অনেকটুকু চাওয়া। প্রকৃতি কথা বলে, বাতাস এসে বলে যায় অনেক কথা। নদীতীরে যদি থাকে বটের ঝুরি, তাহলে তো কথাই নেই। বটগাছের ঝুরি আর গল্পের ঝুড়ি যেন দুই বোন। বটের ঝুরির আহ্বান প্রকৃতির পানে, আর গল্পের ঝুড়ি নিয়ে যায় আকাশপানে। গাছের ছায়ায় বসে একদিন নবী ঘুমিয়ে পড়লেন। তাঁর গায়ে মাদুরের দাগ বসে গিয়েছিল। সাথি বললেন, ‘ইস্, আপনার গায়ে কেমন দাগ পড়ে গেছে। আমি কেন একটি চাদর নিয়ে আসতে পারিনি।’ নবী বললেন, ‘এই গাছের ছায়া আমাদের জন্য ক্ষণিকের। আমরা সবাই এ পৃথিবীতে মুসাফির বই তো নয়। এখনই চলে যাব কোন পার থেকে কোন পারে।’ অনেকে জানেন, রুমির গল্প বলা শুরু করেছি। তাঁর অলৌকিক বাগানের প্রতিটি কবিতা-গল্প আখ্যায়িকা যেন বটগাছের ছায়ায় বসে শোনা গল্পের মতোই চিত্তাকর্ষক।
রুমির যখন পাঁচ বছর বয়স, কয়েকজন সমবয়সীর বন্ধুর সঙ্গে খেলছিলেন ছাদে। একজন বন্ধু বললেন, এক ছাদ থেকে আরেক ছাদে লাফিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা। রুমি বললেন, এ আর এমন কী? এ তো কুকুর-বেড়ালদের সাজে। বলতে বলতে সবুজ কাপড় পরা কয়েকজন অশরীরী ব্যক্তির সঙ্গে মুহূর্তে আকাশের দিকে ধাবিত হলেন রুমি। ছেলেদের কোলাহলে খানিকক্ষণ পর আবার তিনি ফিরে এলেন মর্তলোকে। বিস্ময়কর এ কাহিনি। বিস্ময় তাঁর সারা জীবনের কর্মকাণ্ডে।
‘চন্দ্রমুখ’ ও ইন্টারনেটে উৎসাহী যাঁরা, অন্তত ১০টি নতুন গল্পের ঝুড়ির সন্ধান পাবেন প্রতিদিন। পুরোনো মিডিয়াকে হটিয়ে দিচ্ছে নতুন মিডিয়া। অনলাইনে পড়ে শিলিগুড়ি থেকে ভোর পাঁচটায় ফোন এল: জানলাম রুমির কথা। আপনি ‘ঋষিকবি’ বলে সম্বোধন করেছেন তাঁকে। তিনি তো রবিঠাকুর। বললাম, রবি প্রতিদিনের সূর্য। রুমি ২৮ বছর আগের জ্বলন্ত সূর্য, যার মস্নবী সমস্ত বিশ্বকে পাগল করে দিয়েছে। প্রতিদিন টেলিফোন। বাংলার নদীতীরে বটের ঝুরিতে এ কেমন নতুন মস্নবী। সীমানা পেরোলেই তো আসল বিস্ময়। ওদিকটা তো কেউ দেখিনি। খোঁজও করেনি।
ভূগোলের উচ্চতা ও আধ্যাত্মিক উচ্চতার কি কোনো যোগাযোগ থাকতে পারে? সেই ছোটবেলা থেকে উত্তরাঞ্চলের সাধু-সন্ন্যাসীদের দেখে মনে যুগপৎ ভয় ও জানার আগ্রহ জাগত। ওঁরা কেন অন্য রকম, ওঁদের কী দুঃখ, ওঁরা কী পায় হিমালয়ের গুহায় পথে পথে। হেঁটে, দুর্গম পাহাড়ি চড়াই-উতরাই অতিক্রম করে, হিমালয়ের তুষারাবৃত মনোরম নানা শৃঙ্গের কাছাকাছি সাধুরা কাকে খুঁজে বেড়ান?
‘ও প্রাণ সাধু রে, কী খুঁজি পাইলি না তুই, সারা জীবনভর’।
কুম্ভের মেলায় গঙ্গার তীরে লাখ লাখ গৃহত্যাগী-সংসারত্যাগী নগ্ন ফকিরদের মিছিল ভাবিয়ে তুলত, এখনো ভাবায়। অনেক আশ্রম আছে, যেখানে মন্দির নেই, মূর্তি নেই, নেই পূজা ঘণ্টাধ্বনি। ওঁরা তাহলে কাকে খুঁজছে? ওই পথে নিরুদ্দেশ যাত্রা আমার একটি স্বপ্ন। ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ ও ‘দেবতাত্মা হিমালয়’ বই দুটি আমাকে এই স্বপ্ন দেখিয়েছে।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: লেখক ও সংগীত ব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.