মেয়ের শ্লীলতাহানি, মা-বাবাকে লাঠিপেটা-আদালত চত্বরে পুলিশি নিষ্ঠুরতা

আদালতে বিচারপ্রার্থী এক তরুণী ও তাঁর মা-বাবাকে প্রকাশ্যে নির্যাতন ও হয়রানি করেছে পুলিশ। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের চত্বরে কয়েকজন পুলিশ সদস্য এ ঘটনা ঘটান। ওই তরুণী বলেন, পুলিশ লোকজনের সামনে থেকে তাঁকে জোর করে আদালত ভবনসংলগ্ন পুলিশ ক্লাবের ক্যানটিনে নিয়ে শ্লীলতাহানি করে। এ সময় পুলিশ তাঁকে ও তাঁর মা-বাবাকে মারধর করে এবং ধরে নিয়ে যায়।


দিনভর হেনস্তা শেষে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামালের হস্তক্ষেপে রাত পৌনে ১০টায় তিনজনকেই ছেড়ে দেয় পুলিশ। এর আগে ঘটনা শুনে সুলতানা কামাল ছুটে যান কোতোয়ালি থানায়। সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত পুলিশের সঙ্গে দেনদরবার করেন। একপর্যায়ে তিনি পুলিশকে বলেন, তাঁদের না ছাড়া পর্যন্ত তিনি থানা ছাড়বেন না। এ কথা বলে ওসির কক্ষের বাইরে অবস্থান নেন সুলতানা কামাল। শেষ পর্যন্ত রাত পৌনে ১০টার দিকে পুলিশ নির্যাতনের শিকার তরুণী ও তাঁর মা-বাবাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এরপর আটক আইনজীবীদেরও ছেড়ে দেয় পুলিশ।
ঘটনার শুরু দুপুর ১২টার দিকে। বেলা সাড়ে তিনটায় নির্যাতনের শিকার ওই তরুণী পুলিশ ক্লাবের সামনে এসে সাংবাদিক ও আইনজীবীদের কাছে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সহায়তা চান। এর একপর্যায়ে কোতোয়ালি থানার পুলিশ সাংবাদিক ও আইনজীবীদের লাঠিপেটা করে মেয়েটি ও তাঁর মাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। পুলিশের লাঠির আঘাতে আহত হয়েছেন তিন সাংবাদিক। তাঁরা হলেন প্রথম আলোর আদালত প্রতিবেদক প্রশান্ত কর্মকার, কালের কণ্ঠ পত্রিকার আবদুল জলিল ও বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর তুহিন হাওলাদার। এ ছাড়া আইনজীবী সাখাওয়াত হোসেন ও শিক্ষানবিশ আইনজীবী রাশেদকে বেধড়ক পিটিয়ে গাড়িতে তোলে পুলিশ। রাতে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
নির্যাতনের বর্ণনা: সন্ধ্যায় কোতোয়ালি থানায় সুলতানা কামাল, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও গণমাধ্যমের কর্মীদের সামনে ঘটনার বর্ণনা দেন ওই তরুণী। জানান, স্বামীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের মামলা করতে মা-বাবার সঙ্গে রাজধানীর উত্তরখান এলাকা থেকে আদালতে এসেছিলেন তিনি। কিন্তু দেরি হওয়ায় মামলা করা যাবে না বলে তাঁদের আইনজীবী আজ বুধবার আবার আসতে বলেন। আইনজীবীর কথা শুনে তাঁরা তিনজন একটি মোটরসাইকেলে করে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে বের হওয়ার সময় ফটকেই তাঁদের আটকায় পুলিশ। তখন দুপুর ১২টার মতো।
মেয়েটি বলেন, ‘পুলিশের একজন কর্মকর্তা আমার বাবার মোটরসাইকেল বন্ধ করে চাবি নিয়ে নেন। এ সময় আমি ও মা এর প্রতিবাদ করলে পুলিশ বলে, এই মোটরসাইকেলটি চোরাই। বাবার বিরুদ্ধে নাকি ডাকাতির মামলা আছে। একজন পুলিশ তখন বাবার শার্টের কলার ধরে টানতে থাকলে মোটরসাইকেল কাত হয়ে আমরা পড়ে যাই। এরপর পুলিশ বাবাকে মারতে মারতে মা-সহ আমাকে পুলিশ ক্লাবের ভেতরে নিয়ে যায়। সেখানে বাবাকে একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। আমাকে ও আমার মাকে পৃথক কক্ষে রাখা হয়। একপর্যায়ে দুজন পুলিশ সদস্য আমাকে জড়িয়ে ধরেন। এঁদের একজন জামান (পোশাকের নামফলক অনুযায়ী) আমার সঙ্গে চরম অশালীন আচরণ করেন। আমার গালে-গলায় চুমু দেন। মোটা ও কালোমতো এক পুলিশ সদস্য গলা থেকে চেইন খুলে নেন। আমি প্রতিবাদ করলে গালে চড় মারেন। এতে আমার কানের দুল চামড়া কেটে ভেতরে ঢুকে যায়। তখন আমি চিৎকার করে মাকে ডাকতে থাকি। চিৎকার শুনে মা-ও চিৎকার করতে থাকেন। একপর্যায়ে পুলিশেরই কয়েকজন কর্মকর্তা এসে আমাদের উদ্ধার করেন।’
মেয়েটি বলেন, এরপর তাঁদের তিনজনকেই কোতোয়ালি থানায় নেওয়া হয়। তাঁর বাবাকে হাজতে নেওয়া হয়। আর তাঁকে ও তাঁর মাকে একটি কক্ষে বসিয়ে রাখা হয়। বিকেলের দিকে তিনি ও তাঁর মা বেরিয়ে আদালত চত্বরে যান। সেখানে আইনজীবী ও সাংবাদিকদের কাছে ঘটনার বর্ণনা দেওয়ার সময় পুলিশ তাঁদের ওপর আবারও আক্রমণ করে।
মেয়েটির মা বলেন, ১৭ বছর প্রবাসে থাকার পর তিন বছর আগে দেশে ফেরেন তাঁর স্বামী। দেশে অটোরিকশা কিনে ব্যবসা শুরু করেন তিনি। আট মাস আগে তাঁর মেয়ে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ত। পরে পারিবারিক পছন্দে তাঁকে বিয়ে দেওয়া হয়। মায়ের অভিযোগ, বাবু নামের বংশাল থানা-পুলিশের একজন তথ্যদাতার (ইনফরমার) সঙ্গে তাঁর স্বামীর পুরোনো বিরোধ ছিল। দীর্ঘদিন পর আদালত চত্বরে তাঁর স্বামীকে দেখে ওই বাবু পুলিশ লেলিয়ে দেয় তাঁদের বিরুদ্ধে।
পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার হারুন অর রশীদ মেয়েটির এই অভিযোগকে ‘সাজানো নাটক’ বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, মেয়েটির বাবা বংশাল থানার একটি ডাকাতি মামলার সন্দেহভাজন আসামি।
কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহউদ্দীন খান লাঠিপেটা করা প্রসঙ্গে বলেন, ‘মেয়েটির ঘটনাকে পুঁজি করে কিছু দুষ্কৃতকারী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর চেষ্টা করলে তাঁরা পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন। আল্লাহর রহমতে আমি ও এসি স্যার (রাজিব) থাকায় দুষ্কৃতকারীরা তা করতে পারেনি।’
পুলিশের লাঠিপেটা: বিকেল সাড়ে চারটার দিকে লালবাগ বিভাগের সহকারী কমিশনার রাজিব আল মাসুদ ও ওসি সালাহউদ্দীন খান একদল পুলিশ নিয়ে পুলিশ ক্লাবের সামনে যান। মেয়েটি ও তাঁর মাকে ঘিরে থাকা সাংবাদিক ও আইনজীবীদের তাঁরা চলে যেতে বলেন। মেয়েটিকে ওসি বলেন, ‘আপনাদের থানায় থাকতে বলছি, আপনারা এখানে কেন? থানায় চলেন।’ তখন মেয়েটি বলেন, ‘থানায় যাব না। ওখানে আমার আব্বুকে মেরে আটকিয়ে রেখেছে।’
তখন ওসি সালাহউদ্দীন বলেন, ‘তোমার বাবার বিরুদ্ধে তো কোনো মামলা হয়নি।’ মেয়েটি বলেন, ‘না, আমি একা যাব না। সাংবাদিকদের নিয়ে যাব।’ এ সময় উপস্থিত সাংবাদিক ও আইনজীবীরাও মেয়েটির পক্ষ নিলে ওসি বলেন, ‘এই ধর সব কটাকে; গাড়িতে তোল, মার।’ ওসির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রথম আলোর আদালত প্রতিবেদক প্রশান্ত কর্মকারকে তখন ধরে গাড়িতে তোলার চেষ্টা করা হয়। আরেক সাংবাদিক তুহিন হাওলাদার তাঁকে ছাড়িয়ে নেন। পুলিশ আবার তাঁকে ধরার চেষ্টা করলে সাংবাদিক আবদুল জলিল ছাড়িয়ে নেন। এ সময় পুলিশের লাঠির আঘাতে আহত হন এই তিন সাংবাদিক। পুলিশ প্রশান্তর কোট ও চশমা খুলে নিয়ে যায়।
এরপর ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম বিকাশ কুমার সাহা আদালত প্রতিবেদকদের সংগঠন কোর্ট রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের ডেকে বিষয়টি সমাধানের আশ্বাস দেন। তবে প্রতিবেদকেরা পুলিশের এসি রাজিব ও ওসি সালাহউদ্দীনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার দাবি জানান।
পুলিশের বক্তব্য: পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার হারুন উর রশীদ সন্ধ্যায় কোতোয়ালি থানায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘বংশাল থানার একটি মামলায় মেয়েটির বাবাকে গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ তাঁদের থামায়। তখনই মেয়েটি ও তাঁর মায়ের সঙ্গে পুলিশের হিচিং হয়। এরপর পুলিশ তিনজনকেই পুলিশ ক্লাবের ভেতরে নিয়ে যায়। একটু পরে মেয়ে ও তাঁর মাকে বের করে দেওয়া হয়।’
ঘটনা তদন্তে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা হলেন লালবাগ বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মারুফ সরদার ও সহকারী কমিশনার (এসি) রাজিব আল মাসুদ।
রাতে ঢাকা মেডিকেলে: রাতে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল মেয়েটির বাবাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করান। চিকিৎসকেরা জানান, মেয়েটির বাবার মাথায়, চোখে, কাঁধে ও পিঠে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
মেয়েটি জানান, পুলিশ তাঁর বাবার দুই চোখে আঙুল দিয়ে চেপে ধরেছিল। তারা চোখ গেলে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল।

No comments

Powered by Blogger.