কালের পুরাণ-জয়ী হয়েছে গণতন্ত্র, পরাস্ত অহমিকা by সোহরাব হাসান

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কে জয়ী হয়েছে? কে পরাস্ত হয়েছে? ভোটাররা যাঁদের প্রতিনিধি হিসেবে বাছাই করেছেন, তাঁরা জয়ী হয়েছেন। জয়ী হয়েছে নির্বাচন কমিশন, যার দায়িত্ব ছিল একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার। জয়ী হয়েছেন সুকান্তের ভাষায় বীর চট্টলার জনগণ, যারা পরিবর্তন চেয়েছিল। এসব ছাড়িয়ে যে জয়টি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হলো গণতন্ত্রের জয়। জনশক্তির জয়।
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তো আগাম ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন, চট্টগ্রামের নির্বাচনে কারচুপি হলে সরকার পতনের আন্দোলন শুরু করবেন। নির্বাচন কমিশনকে পদত্যাগে বাধ্য করবেন। কারচুপি হয়নি। এখন কি তিনি সরকার পতনের লক্ষ্যে আহূত ২৭ জুনের হরতাল প্রত্যাহার করবেন? এখন কি তিনি নির্বাচন কমিশনকে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুষ্ঠু ও সুুচারুভাবে পাল
ন করার জন্য ধন্যবাদ জানাবেন? কেন জানাবেন না? ১৭ জুন যদি চট্টগ্রামে মহিউদ্দিন চৌধুরীর স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে নীরব ভোট-বিপ্লব হয়ে থাকে, তাহলে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর খালেদা-তারেক-নিজামীদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সরব ভোট-বিপ্লব হয়েছিল। প্রথমটি জিন্দাবাদ পেলে দ্বিতীয়টি নিন্দাবাদ পাবে কেন?
আমাদের দেশে জনগণের রায় বা নির্বচনী ফল উল্টে দেওয়ার বহু নজির আছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তার পুনরাবৃত্তি হয়নি বলে নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ জানাই। ধন্যবাদ জানাই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী, নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসনিক কর্মকর্তাদেরও। বিরোধী দলের শঙ্কা ও অভিযোগকে অমূলক প্রমাণ করে তাঁরা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন জাতিকে উপহার দিয়েছেন।
নির্বাচন কমিশন বেসরকারিভাবে মন্জুর আলমকে মেয়র ঘোষণা করেছে। প্রায় এক লাখ ভোটের ব্যবধানে তিনি তাঁর এককালীন ‘রাজনৈতিক গুরু’ মহিউদ্দিন চৌধুরীকে গো-হারা হারিয়ে দিয়েছেন। নির্বাচনী ফল দেখে ধারণা করা যায়, চট্টগ্রামবাসী মহিউদ্দিন চৌধুরীর উৎপাতে কতটা অতিষ্ঠ ছিল। সাধারণ মানুষের হাতে কোনো অস্ত্র নেই, বর্ম নেই, শক্তি নেই। কেবল একটি ব্যালটের শক্তিতে তাঁরা বাদশাহকে ফকির এবং ফকিরকে বাদশাহ করে দিতে পারেন। আজ যে জনগণ মহিউদ্দিন চৌধুরীকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, সেই জনগণই কিন্তু তাঁকে তিন-তিনবার মেয়র নির্বাচিত করেছেন। অতএব, জনগণই যে সব ক্ষমতার উৎস, এ কথাটি নেতা-নেত্রীরা বিরোধী দলে গিয়ে দোয়া ইউনুস পড়ার মতো জপ না করে ক্ষমতায় থাকতেও যদি স্মরণ করেন, তাহলে দেশের অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যেত।
এ নির্বাচনে মহিউদ্দিন চৌধুরী কত বেশি ভোটে হেরেছেন, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, তাঁর অহমিকা চূর্ণ হয়েছে। ভোটারদের প্রতি একজন মেয়রের অবজ্ঞা, কথায় কথায় নারী কাউন্সিলরদের অপমান এবং শতবর্ষী বিপ্লবী বিনোদবিহারীর প্রতি কটাক্ষের মোক্ষম জবাব দিয়েছেন ভোটাররা। ভোটের মাধ্যমে জনগণ দেখিয়ে দিয়েছে, তারাই সার্বভৌম। তাদের সম্মিলিত শক্তির কাছে ব্যক্তি-অহমিকা, ঔদ্ধত্য যত প্রকটই হোক, পরাস্ত হতে বাধ্য। তিনি চট্টগ্রামের ‘কাল্ট’ হয়ে গিয়েছিলেন, আইনকানুন, বিধিশৃঙ্খলা—এসব তাঁর জন্য নয়। তিনি যা চাইবেন, চট্টগ্রামে তা-ই হবে। তাঁর কথায় বন্দর চলবে, তাঁর কথায় বন্ধ হবে। এ হতে পারে না। ব্যক্তির খেয়ালে প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না, চট্টগ্রামের ১৬ লাখ মানুষও জিম্মি থাকতে পারে না।
এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী গত দেড় দশকে চট্টগ্রাম নগরের উন্নয়নে কিছু করেননি, সে কথা আমরা বলছি না। তিনি রাস্তাঘাট প্রশস্ত করেছেন, বড় বড় শপিংমল করেছেন, অনেক স্কুল-কলেজ করেছেন। স্বাস্থ্যসেবায় সফল কর্মসূচি নিয়েছেন। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে আর্থিক সচ্ছলতা দিয়েছেন। কিন্তু চট্টগ্রাম নগরের প্রধান দুই সমস্যা—জলাবদ্ধতা ও চাকতাই খাল ভরাটের ব্যাপারে তিনি নীরব থেকেছেন। অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে তিনি ছুটেছেন চমক ও জনপ্রিয়তার পেছনে। কাতারবন্দী করে মানুষকে তীর্থে পাঠানো সিটি করপোরেশনের কাজ নয়। এসব করে অনেক জরুরি কাজ ফেলে রেখেছেন। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করতেও দ্বিধা করেননি মহিউদ্দিন চৌধুরী। তাঁর ক্ষমতা ছিল, কর্মী ও ক্যাডার ছিল, ভয়ে এত দিন কেউ কথা বলেননি। এবারই জনগণ সুযোগ পেয়ে তাঁকে একহাত দেখিয়ে দিয়েছেন। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল একজন রাজনীতিক হিসেবে, তাতে শরিক হওয়া দোষের কিছু নয়। কিন্তু আন্দোলনের নামে বিমানবন্দর ভাঙচুর কিংবা বন্দরকে জিম্মি করা মানুষ ভালোভাবে নেয়নি।
প্রশ্ন উঠতে পারে, তার পরও ২০০৫ সালে জনগণ তাঁকে কেন পুনর্নির্বাচিত করল। তখন ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোট সারা দেশে যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল, তারই জবাব দিয়েছিল চট্টগ্রামবাসী ভোটের মাধ্যমে। আজ সেই ত্রাস নেই, তবে অন্য ত্রাস উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। জনগণের প্রতিবাদী কণ্ঠ স্তব্ধ করতে বিএনপি সরকার যেসব কালো আইন ব্যবহার করেছিল, বর্তমান সরকারও সে পথই অনুসরণ করছে। এর ফলও ভালো হতে পারে না।
একটি স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনের ফলাফলে আওয়ামী লীগ সরকারের পরাজয় ঘটবে না, সংসদে আসনও কমবে না। কিন্তু জাতীয় সংসদে বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের দেড় বছরের মাথায় চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে এ ভরাডুবি কেন ঘটল? যে ভোটাররা চট্টগ্রামের পাঁচটি আসনই আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটকে উপহার দিয়েছিলেন, সেই ভোটাররা তাঁদের সমর্থিত প্রার্থীকে এভাবে প্রত্যাখ্যান করলেন কেন? যেখানে পরীক্ষিত প্রবীণ নেতারা গিয়ে চট্টগ্রামে পড়ে ছিলেন, ২০-২২ জন সাংসদ গোটা শহর চষে বেড়িয়েছেন, সেখানে এ ফল কেন হলো? আওয়ামী লীগের নেতারা কি গভীরভাবে চিন্তা করবেন? এ রায় কি শুধু মহিউদ্দিনের প্রতি অনাস্থা, না সরকারের প্রতিও? প্রতিপক্ষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা আওয়ামী রাজনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কথা বলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল, সেই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তারা গত ১৮ মাসে কী করেছে? এ হিসাব জনগণ চাইতেই পারে। আওয়ামী লীগ দিনবদলের কথা বলে ভোটারদের ভুলিয়েছিল। এখন দেখা যাচ্ছে, কিছুই বদলাচ্ছে না। খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের আড়াই বছরের মাথায় যখন মোহাম্মদ হানিফ ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বচনে জিতেছিলেন, তখন থেকেই বিএনপির ক্ষণ গণনা শুরু হয়েছিল। আওয়ামী লীগ এভাবে দেশ চালালে জনগণ তাদের থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিতে সময় লাগবে না।
অতি আত্মবিশ্বাসী আওয়ামী লীগের নেতারা ভেবেছিলেন, মহিউদ্দিন চট্টগ্রামের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা। তাঁকে কেউ হারাতে পারবেন না। অতীতে অনেক বড় নেতা ধূলিসাৎ হয়ে গেছেন। মনে করা হতো, মহিউদ্দিনের কথায় চট্টগ্রাম চলবে, সেই ধারণার পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের জাতীয় নেতাদের কেউ কেউ সেই ভাষায়ই কথা বলছেন। সরকারি দলের হাবভাবে মনে হচ্ছে, তারা চিরদিন ক্ষমতায় থাকবে। আর বিরোধী দল বোঝাচ্ছে, এখন সংসদে গিয়ে কী হবে, আর কয়েক দিন পরই তো তারা ক্ষমতায় আসছে। এই হলো আমাদের গণতন্ত্র!
স্বীকার করি, চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের মধ্যে এক ধরনের বিজয়ও আছে। সরকার এখন জোর দিয়ে যে কথাটি বলতে পারে তা হলো, আওয়ামী লীগের আমলেও অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে এবং বর্তমান নির্বাচন কমিশনও একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে সক্ষম। বিরোধী দল এত দিন যে বলে আসছিল, ২০০৮ সালের নির্বাচন ছিল সাজানো, নির্বাচন কমিশন সরকারের আজ্ঞাবহ। এখন তারা কী বলবে? এটিও সাজানো নির্বাচন? বলতে পারেন, ইতিমধ্যে কেউ কেউ বলেছেন, নির্বাচনে ডিজিটাল কারচুপি হয়েছে। চট্টগ্রামে নির্বাচন হলো, ফল ঘোষণা করার আগেই ঢাকায় গাড়ি ভাঙচুর করা হলো। জনগণের মন জয় করতে হলে একটু ধৈর্য ও সহনশীলতা থাকা প্রয়োজন, যা আমাদের রাজনীতিকদের মধ্যে নেই। এ নির্বাচনে দেশবাসীর জন্য সুসংবাদ হলো, অন্তত এ মুহূর্তে খালেদা জিয়া সরকার পতনের আন্দোলন করতে পারছেন না। আর সরকারের জন্য আট নম্বর হুঁশিয়ারি হলো, আগামী সাড়ে তিন বছর ক্ষমতা ধরে রাখতে হলে, দেশ চালাতে হলে নতুন করে ভাবতে হবে। পুরোনো ধ্যানধারণা দিয়ে চলবে না।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ রাজনীতি ও নেতাদের কাছে খুব বেশি আশা করে না। ১৯৩৭ সাল থেকে তারা বহুবার ভোট দিয়ে সরকার পতন করেছে, দুবার পতাকা বদল করেছে, তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। তবে তারা একটি কাজ করতে পারে তা হলো, ক্ষমতাসীনদের দম্ভ ও আস্ফাালন চূর্ণ করে দেয়া। তারা কাউকে এভারেস্টে ওঠাতে পারে, আবার বঙ্গোপসাগরেও ছুড়ে ফেলে দিতে পারে। পূর্বাপর সরকারগুলো পাহাড়ে উঠে নিচের মানুষের কথা ভুলে গেছে, বর্তমান সরকার বা চট্টগ্রামের মেয়র একই কাজ করলে তাঁকেও নামাতে সময় লাগবে না।
চট্টগ্রামবাসী মন্জুর আলমকে নির্বাচিত করেছে চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য, সেখানকার মানুষের সমস্যা দূর করার জন্য। কিন্তু তাঁকে দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থে যদি কেউ ব্যবহার করে, তার পরিণামও ভালো হবে না। মাত্র দেড় বছর আগে যে চট্টগ্রামবাসী বিপুল ভোটে চট্টগ্রামের পাঁচটি আসন আওয়ামী লীগকে দিয়েছে, সেই চট্টগ্রামবাসী প্রায় এক লাখ ভোটে হারিয়ে দিয়েছে মহিউদ্দিন চৌধুরীকে। এত কম সময়ে, এত ভোটের ব্যবধান। কেবল মহিউদ্দিন চৌধুরী নন, কাউন্সিলর পদেও আওয়ামী লীগের পরাজয় ঘটেছে। ৪১টি পদের মধ্যে ২০টি পেয়েছে।
চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়ন কি ঠিক ছিল? মহিউদ্দিনের জনপ্রিয়তা কি আগের অবস্থানে আছে? না থাকলে আওয়ামী লীগ নতুন প্রার্থীর সন্ধান করল না কেন? মন্জুর আলম তো আওয়ামী লীগেরই লোক ছিলেন, নির্বাচনের কারণেই তিনি বিএনপিতে গেছেন।
সামনে ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। সেখানেও যদি তারা ভুল প্রার্থী দেয়, একই ফল হবে। মানুষ কিন্তু তেতে আছে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.