এক জীবনে দুই জীবন by আহমেদ হাসান

৩০ বছর একটানা ধূমপান করেছি। এর মধ্যে ২২ দিনের বিরতি ছিল, তাও আবার একটানা নয়, ভেঙে ভেঙে। এই ২২ দিনের চার দিন ছিল কানাডায় ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়ে, সেখানে বাধ্য হয়েছিলাম ধূমপান না করতে। আর বাকি দিনগুলো টাইফয়েডজাতীয় রোগে অসুস্থ থাকার কারণে।


আমার নিজের পছন্দের ব্র্যান্ড ছাড়া কোনো সিগারেট খেতাম না। শেষ ২০ বছর শুধু লাল প্যাকেটের মার্লবোরোই খেয়েছি। সেটাও যেকোনো দেশের তৈরি হলেই হতো, তা নয়। আফ্রিকার একটি দেশের বা লাতিন আমেরিকার নির্দিষ্ট দুটি দেশ কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের হতেই হতো। গুলশানের শুধু দুটি দোকানই আমার পছন্দের জিনিসটা দিতে পারত। একসঙ্গে কয়েক কার্টন সিগারেট একবারে কিনে রাখতাম। এক কার্টন সব সময় গাড়িতে রাখতাম, কারণ আমি দেশের যেখানেই যাই, গাড়ি আমার সঙ্গে থাকে। দেশে যাঁরা আমার সঙ্গে কাজ করতেন, তাঁরা প্রায় সবাই জানতেন, সিগারেট খাওয়ার ভালো ব্যবস্থা রাখতে পারলে আমার কাছ থেকে কাজের ভালো ফল বের করা সম্ভব। আমার ব্র্যান্ডের সিগারেট হাতের কাছে না থাকলে অস্থির হয়ে যেতাম, অনেক সময় মনে হতো, যেন অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। বিদেশে যখন গেছি, সঙ্গে কয়েক কার্টন মার্লবোরো নিয়ে গেছি ঢাকা বিমানবন্দরের ‘ডিউটি ফ্রি’ দোকান থেকে।
গড়ে প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০টি শলাকা খেয়েছি। রাত জাগলে, পার্টি থাকলে, কিংবা সৃজনশীল কোনো কিছু করলে এটা আরও বেড়ে যেত। মনে হতো, সিগারেটই জীবনের অনেক অসম্পূর্ণতাকে পূর্ণতা দিয়েছে।
ধূমপান যে ছেড়ে দেব, এটা আমি কখনো তেমন করে ভাবিনি। যুক্তরাষ্ট্রে যখন বেড়াতে গেলাম, তখন আমার মেজো ভাবি প্রায় ১০০ ডলার দিয়ে দিয়ে কিনে সিগারেটের প্যাকেট আকারের একটা কিছু ধরিয়ে দিল। একদিকে আঠা লাগানো ছোট ছোট কাগজ, শরীরের যে কোনো অংশে লাগিয়ে রাখতে হয়। এটা হোল নিকোটিন প্যাচ, ধুমপান যাঁরা ছেড়ে দিতে চান তাঁদের জন্য। আমি প্যাকেটটা নিয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু কখনো খুলে দেখিনি।
অনেকে সংখ্যা কমিয়ে সিগারেট ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করে বলে শুনেছি, যেটা আমি কখনো করিনি। ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার বিশেষ কোনো প্রয়োজন আমি কখনো বোধ করিনি। যদিও আমি ধূমপান বরাবরই খুব উপভোগ করতাম, তবু বছর দুই আগে আমি মাঝেমধ্যেই কল্পনা করতে চাইতাম, যদি সিগারেট ছেড়ে দিই, তবে সেটা কেমন হবে? একসময় অনুভব করলাম, সিগারেট ছাড়া জীবন—এটা হবে আমার জন্য একটা নতুন জীবন। এক জীবনে দুই জীবন পাওয়া—এই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা পাওয়ার জন্য আমিও ব্যাকুল হয়ে উঠলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, এই রোমাঞ্চ আমি পরখ করে দেখবই। আজ থেকে দেড় বছর আগে সেদিন আমি ঠান্ডা ও সর্দিজ্বরে কিছুটা অসুস্থ ছিলাম। আমার খুব ভালো দুই বন্ধু বলল, সিগারেট ছেড়ে দিতে। আমি বললাম ঠিক আছে, ছেড়ে দিলাম এবং সেদিনই ছেড়ে দিলাম। এরপর আর কখনো সিগারেট খাইনি। ইচ্ছা করেছে অনেকবার, কিন্তু খাইনি। কারণ আমার চোখে তখন নতুন আরেক জীবনের স্বাদ নেওয়ার উদগ্র আকাঙ্ক্ষা।
সিগারেট ছাড়া আমার দেড় বছর হয়ে গেছে। এখন আমি অন্য মানুষ।
শরীর অনেক সতেজ, যখন তখন ঝিমুনি আসে না, দ্রুত হাঁটাচলা করলেও এখন আর হাঁপিয়ে উঠি না। মুখের চামড়া আর কুঁকড়ে থাকে না বা পোড়া পোড়া বলে অনুভূত হয় না, ভোরে ঘুম থেকে উঠলে তামাকের আঁশটে ভাবটা আর পাই না। এখনকার পার্টি বা ছুটোছুটি আরও বেশি উপভোগ্য। যারা আমাকে মাঝেমধ্যে দেখে, তারা এখন প্রায়ই বলে, ‘দেখতে খুব ফ্রেশ লাগছে।’ আমি তো বুঝি এটা কেন লাগছে, কারণ ভেতরটাই যে এখন অনেক সতেজ।
আহমেদ হাসান: তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা

No comments

Powered by Blogger.