জ্বালানির হিসাব বলছে এবার লোডশেডিং বেশি হবে by অরুণ কর্মকার

সরকার এ বছর গ্রীষ্ম মৌসুমে লোডশেডিং এক হাজার মেগাওয়াটের মধ্যে সীমিত রাখার কথা বললেও জ্বালানির (তেল-গ্যাস) হিসাব বলছে, লোডশেডিং অনেক বেশি হবে। এমনকি চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ঘাটতি দুই হাজার মেগাওয়াটও ছাড়িয়ে যেতে পারে।

সরকারি-বেসরকারি সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে পাওয়া তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, জ্বালানির স্বল্পতা, বিদ্যুৎকেন্দ্রের নানা সমস্যা এবং বিতরণব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে এ বছর গ্রীষ্মেও বিদ্যুৎ-পরিস্থিতি বেশ খারাপ থাকবে। চলতি সেচ ও গ্রীষ্ম মৌসুমের শুরু থেকেই ঢাকাসহ সারা দেশের লোডশেডিং-পরিস্থিতির মাধ্যমে এর আলামতও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি: গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোতে গ্যাসের চাহিদা প্রতিদিন প্রায় ১০০ কোটি (১০০০ মিলিয়ন) ঘনফুট। বর্তমানে দেওয়া হচ্ছে আশি কোটিরও কম। গতকাল বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে ৭৮ কোটি ৮০ লাখ ঘনফুট। একাধিক সার কারখানা বন্ধ করে বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে আগেই। কিন্তু কোনোভাবেই ১০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করা সম্ভব হবে না বলে পেট্রোবাংলা সূত্র জানিয়েছে।
সরকার এখনো ভাড়াভিত্তিক ও কুইক রেন্টাল মিলিয়ে মোট ২০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি সই করেছে। এর মধ্যে ১৭টি চালু হয়েছে। বাকি তিনটি এ মাসেই চালু হওয়ার কথা। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় চুক্তি করা প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রও ভাড়াভিত্তিক ও তেলচালিত। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য বছরে প্রায় ২০ লাখ টন জ্বালানি (ফার্নেস ও ডিজেল) তেল দরকার।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্র জানায়, এ বছরের জানুয়ারি থেকে আগামী জুন পর্যন্ত ছয় মাসের জন্য পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) কাছে তারা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য মোট নয় লাখ ৭০ হাজার টন জ্বালানি তেলের চাহিদা দিয়েছিল। এর মধ্যে সাত লাখ ৩০ হাজার টন ফার্নেস তেল ও দুই লাখ ৪০ হাজার টন ডিজেল।
বিপিসি সূত্র জানায়, জ্বালানি তেলের ওই চাহিদা কমিয়ে মোট চার লাখ ৬৮ হাজার টন করা হয়েছে। এর মধ্যে ফার্নেস তেল তিন লাখ ৯০ হাজার টন ও ডিজেল ৭৮ হাজার টন।
সূত্র জানায়, যান্ত্রিক ও কারিগরি সমস্যার কারণে অধিকাংশ তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র পূর্ণ ক্ষমতায় উৎপাদন করতে পারছে না, পারবেও না। অধিকাংশ কেন্দ্র নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে অধিক তেল ব্যবহার করছে। সব কেন্দ্রে যথাসময়ে প্রয়োজনমতো তেল সরবরাহও কঠিন। সর্বোপরি বিদ্যুতের উৎপাদন-মূল্য যথাসম্ভব কম রাখার চেষ্টায় তেলের চাহিদা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে তেলচালিত কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিছু কম পাওয়া যাবে।
চাহিদা ও সরবরাহ: পিডিবির হিসাব অনুযায়ী, চলতি মাসের শেষ ভাগ থেকে শুরু হওয়া এ বছরের গ্রীষ্মকালীন সর্বোচ্চ চাহিদা (লোডশেডিংয়ের নির্ধারিত কর্মসূচি বা ডিমান্ড সাইড ম্যানেজমেন্ট বা ডিএসএমসহ) হবে সাত হাজার ৫১৮ মেগাওয়াট। এ সময় উৎপাদনক্ষমতা আট হাজার ৩০০ মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেলেও প্রকৃত সর্বোচ্চ উৎপাদন হবে ছয় হাজার মেগাওয়াট।
এই প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট ঘাটতির সঙ্গে শিল্প ও অন্যান্য গ্রাহকের নতুন সংযোগ দেওয়ার ফলে আরও চাহিদা বাড়বে প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট। আবাসিক গ্রাহকদের নতুন সংযোগ দেওয়া অব্যাহত রাখার পাশাপাশি সরকার ১৮ হাজার ৮৮৭টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানেও নতুন বিদ্যুৎ-সংযোগ দিচ্ছে। এই শিল্পগুলোরই দৈনিক বিদ্যুতের চাহিদা এক হাজার ৩৯৬ মেগাওয়াট।
বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় ও বিতরণ কোম্পানিগুলোর সূত্র জানায়, এ অবস্থায় ঘাটতি আড়াই হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত হতে পারে। একই সঙ্গে সরকার আবাসিক ও শিল্প-গ্রাহকদের কাছ থেকে নতুন সংযোগের জন্য আবেদন গ্রহণ ও পর্যায়ক্রমে সংযোগ প্রদান চালু রাখছে। ফলে চাহিদা ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে।
উৎপাদনের রেকর্ড: ১৬ মার্চ দেশে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ উৎপাদনের রেকর্ড হয়েছে। পিডিবি জানায়, ওই দিন রাত আটটায় পাঁচ হাজার ৫৬৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে। এটি দেশে এযাবৎকালের সর্বোচ্চ উৎপাদন।
সর্বোচ্চ চাহিদা ধরা হয়েছিল পাঁচ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। পরে তা আরও ২০ মেগাওয়াটের মতো বেড়েছে। ফলে রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদনের সময় দেশের কোথাও কোনো লোডশেডিং থাকার কথা নয়।
এর আগে গত বছরের ২৯ আগস্ট সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার ২৪৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছিল।

No comments

Powered by Blogger.