লাদেন হত্যাকাণ্ড-মার্কিনদের সুরক্ষা নিশ্চিত হবে না by ফিদেল কাস্ত্রো

ওয়াকিবহাল ব্যক্তিরা অবগত আছেন, ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর কিউবার জনগণ মার্কিন জনগণের প্রতি সংহতি জানিয়েছিল। নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে নৃশংস হামলার শিকার মানুষের জন্য আমরা স্বাস্থ্যক্ষেত্রে আমাদের সাধ্য অনুযায়ী পরিমিত সহযোগিতা প্রদানের প্রস্তাব করেছিলাম।

সেদিনের সেই হামলার পরক্ষণেই যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল, সে পরিস্থিতিতে যেসব বিমানের কোথাও অবতরণ করার উপায় ছিল না, সেগুলোর জন্য আমরা সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশের বিমানবন্দর খুলে দিয়েছিলাম।
কিউবা বিপ্লবে গৃহীত আমাদের সাধারণ অবস্থান হলো, বেসামরিক নাগরিকদের জীবন হুমকির মুখে ফেলে এমন কাজের সব সময় বিরোধী আমরা—এ তো সর্বজনবিদিত।
যদিও বাতিস্তার জুলুমবাজির বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রতি আমরা দৃঢ় সমর্থন জানিয়েছিলাম, তবু নিরীহ মানুষের জীবন বিপন্ন হয় এমন সব ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ছিল আমাদের নীতিগত অবস্থান। অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে আমরা সেই অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছি। আমাদের এমন আচরণ এসব সংবেদনশীল ব্যাপারে আমাদের মতামত তুলে ধরার অধিকার দিয়েছে।
সেদিন সিয়ুদাদ দেপোর্তিভায় এক গণজমায়েতে বলেছি, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সহিংসতা ও যুদ্ধের মাধ্যমে কখনোই আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস দূর হবে না।
প্রসঙ্গত, ওসামা বিন লাদেন দীর্ঘকাল ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু। যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। ওসামা সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতন্ত্রেরও বিরোধী ছিলেন। তবে কারও নামে যে কাজেরই দায় আরোপ করা হোক না কেন, নিজের আত্মীয়স্বজনের দ্বারা পরিবেষ্টিত ও নিরস্ত্র অবস্থায় কাউকে হত্যা করা ঘৃণ্য কাজ। আপাত প্রতীয়মান হচ্ছে, এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্রের সরকার আসলে সেটাই করেছে।
ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যু ঘোষণা করে প্রদত্ত সুচারু বক্তব্যে বারাক ওবামা বলেছেন, ‘...তবু আমরা জানি, সেসব ছবিই সবচেয়ে ভয়াবহ, যেগুলো বিশ্ববাসীকে দেখানো হয়নি কখনো। খাবার টেবিলে শূন্য চেয়ার। শিশুরা তাদের মা অথবা বাবা ছাড়া বেড়ে উঠতে বাধ্য হচ্ছে। মা-বাবারা আর কোনো দিন তাঁদের সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরার অনুভূতি পাবেন না। আমাদের থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে তিন হাজার নাগরিক, যা আমাদের হূদয় চিরে ফেলে যায় ক্ষতচিহ্ন।’
অনুচ্ছেদটিতে এক নাটকীয় সত্য প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এই কথার প্রলেপ দিয়ে সৎ মানুষকে ভুলিয়ে দেওয়া যাবে না, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কী অন্যায্য যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে ইরাক ও আফগানিস্তানে। লাখে লাখে শিশুকে বাধ্য করা হচ্ছে তাদের মা-বাবা ছাড়া বেড়ে উঠতে এবং মা-বাবা আর কখনো পাবেন না তাঁদের সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরার সেই অনুভূতি।
কোটি কোটি নাগরিককে কেড়ে নেওয়া হয়েছে তাদের গ্রাম থেকে—ইরাক, আফগানিস্তান, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, কিউবা এবং বিশ্বের আরও অনেক দেশে। আরও কোটি কোটি মানুষের মনে এখনো গাঁথা হয়ে আছে কত ভয়াবহ সব ছবি: অধিকৃত কিউবান এলাকা গুয়ানতানামোতে মানুষ হেঁটে যাচ্ছে নীরবে, মাসের পর মাস এমনকি বছরের পর বছর ধরে তাদের ওপর চালানো হচ্ছে তীব্র যন্ত্রণাদায়ক সব নির্যাতন। এরাই সেই মানুষ, যাদের সভ্য সমাজের দাবিদারদের কপট সম্মতিতে অপহরণ করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল গুপ্ত কারাগারে।
ওবামার কোনো সাধ্য নেই আড়াল করার যে, ওসামাকে তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের সামনে হত্যা করা হয়েছে (ওসামার স্ত্রী-সন্তানেরা এখন পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের হেফাজতে) এবং পাকিস্তানের আইন ভাঙা হয়েছে, জাতীয় মর্যাদা বিনষ্ট করা হয়েছে এবং মুসলমানপ্রধান দেশটির ধর্মীয় ঐতিহ্যকে অপবিত্র করা হয়েছে।
যে মানুষটাকে আইনবহির্ভূতভাবে এবং কোনো বিচার না করে মেরে ফেলা হলো, তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের ওবামা কীভাবে আটকাবেন, সেদিন কী ঘটেছিল সেই বর্ণনা প্রদান করা থেকে? সেই ঘটনার ছবি সারা দুনিয়ায় প্রচারিত হওয়া তিনি কীভাবে ঠেকাবেন?
তাঁকে হত্যা করা এবং তাঁর মৃতদেহ সমুদ্রের তলায় ডুবিয়ে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতারই প্রকাশ। এর পরিণতিতে তাঁকে আরও ভয়ানক ব্যক্তিতে পরিণত করা হলো।
মার্কিন জনমত ও প্রাথমিক আনন্দ-উল্লাস শেষ হলে পরে জনগণ সেই সব পন্থার সমালোচনাতেই মুখর হবে, যা নাগরিকদের সুরক্ষা দেওয়া দূরে থাক, তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও প্রতিশোধস্পৃহার বিস্তার ঘটাবে বহুগুণ।

গ্রানমা ইন্টারন্যাশনাল থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
ফিদেল কাস্ত্রো: কিউবার বিপ্লবী ও সাবেক রাষ্ট্রনায়ক।

No comments

Powered by Blogger.