স্মরণ-শিশুসাহিত্যের এক নন্দিত লেখক by লুৎফর রহমান রিটন

রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই সম্পাদিত মাসিক কচি-কাঁচায় ছাপা হয়েছিল আবু কায়সারের ধারাবাহিক উপন্যাস রায়হানের রাজহাঁস। আমাদের শিশুসাহিত্যে আলোড়ন সৃষ্টিকারী রায়হানের রাজহাঁস বই হয়ে বেরোয় ১৯৭৩ সালে। আমাদের কৈশোরকে মুগ্ধতায় ভরিয়ে দিয়েছিল বইটি। আমার ছেলেবেলার বন্ধু শার্লি নিয়মিত আমাকে বই উপহার দিত।

শার্লি একবার আমাকে টিকাটুলী-হাটখোলার ওয়ারী বুক সেন্টার থেকে কিনে একসঙ্গে চারটি বই উপহার দিয়েছিল— মোহাম্মদ নাসির আলীর লেবু মামার সপ্তকাণ্ড, সত্যজিৎ রায়ের প্রফেসর শঙ্কু, খগেন্দ্রনাথ মিত্রের ভোম্বোল সর্দার এবং আবু কায়সারের রায়হানের রাজহাঁস। রায়হানের রাজহাঁস বইটি আমার করোটির ভেতরে কিছু একটা কাণ্ড বাধিয়েছিল।
১৯৮৫ সালে প্রীতিভাজন আমীরুল ইসলাম তাঁর একজন বন্ধুকে নিয়ে হাজির আমাদের ওয়ারীর বাসায়। স্কুলে একসঙ্গে পড়া ওর বন্ধুটি আমি সাতটা নামে আমীরুলের একটি বই প্রকাশের সমস্ত খরচ বহন করতে চায়। বইটির প্রচ্ছদ এঁকে দিতে হবে আমাকে। ওদের সামনেই ঝটপট এঁকে দিলাম মায়াবী চোখের ঝাঁকড়া চুলের স্বপ্নবান এক কিশোরের মুখ। ফ্রি হ্যান্ডে লিখে দিলাম বইয়ের নাম এবং লেখকের নামটিও। ব্লকে ছাপা হলো চাররঙা প্রচ্ছদ। চকচকে আর্ট পেপারে। কদিন পর আমীরুল আর ওর বন্ধুটি সুন্দর বাঁধাই হওয়া বইটি আমাকে দিতে এল যেদিন, সেদিন তো আমার চক্ষু চড়কগাছ! সর্বনাশ! এটা তো প্রায় রায়হানের রাজহাঁস! আমার করোটির ভেতর স্থায়ী আসন করে নেওয়া রায়হানের রাজহাঁস-এর প্রচ্ছদটি কিনা আমি সাতটার প্রচ্ছদে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে!
অনেক দিন পর কবি আবু কায়সারের সঙ্গে যখন আমার খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, তখন একদিন কায়সার ভাইকে বলেছিলাম ঘটনাটা। তিনি দেখতে চেয়েছিলেন। আজিজ সুপার মার্কেটের তিনতলায় আমার ছোটদের কাগজ অফিসে এক বিকেলে এলেন তিনি। তার আগমন-সময়টি পূর্বনির্ধারিত ছিল। আমি বাড়ি থেকে আমি সাতটার আগেই এনে রেখেছি। কায়সার ভাই চা ও সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে টাঙ্গাইলের ডায়ালেক্টে বললেন, ‘শুধু কি প্রচ্ছদটি মেরে দিয়েছ, নাকি ভেতরে মাল-মসল্লাও?’
‘মানে?’
‘মানে বইটা আমার লেখা না তো?’
বলেই স্বভাবসুলভ মৃদু হাসতে লাগলেন কায়সার ভাই। কায়সার ভাইয়ের নির্মল রসিকতায় হেসে উঠলাম আমিও, ‘মে বি, চলেন আমীরুলের বিচার করি, কঠিন বিচার।’
‘তার আগে তোমার বিচারটা হওয়া দরকার। আর্টিস্ট হওয়ার অপচেষ্টা আর কভার নকলের দায়ে তোমার জরিমানা ২০০ টাকা। এখনই ২০০ টাকা দিলে ব্যাপারটা চেপে যাব।’
আমি ওয়ালেটটা খুলে ভেতরের অবস্থাটা বুঝে নিয়ে মুখে কপট করুণ অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুললাম।
‘কায়সার ভাই, একটু কমানো যায় না? ১০০ টাকায় ব্যাপারটা রফা করা যায় না?’
‘তোমরা ছোট ভাই; দাও, ১০০ টাকাই দাও।’
আমার দেওয়া ১০০ টাকা অবলীলায় পকেটে রাখলেন কায়সার ভাই, চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিতে দিতে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘তোমার বোধ হয় লস হয়ে গেল, না?’
‘জি। কায়সার ভাই, পুরোটাই লস। আমি সাতটার প্রচ্ছদ আঁকার বিনিময়ে মগবাজার মোড়ের কন্টিনেন্টাল ফুডে বিরিয়ানি খেয়েছিলাম এক প্লেট। কোনো টাকাপয়সা পাইনি। এত দিন পর সেই বিরিয়ানির টাকা সুদে-আসলে ফেরত দিতে হলো।’
‘মন খারাপ কোরো না। ওতে লাভ হবে না। কারণ, জরিমানার টাকা ফেরত দেওয়ার বিধান নেই। তবে তোমার লোকসান পুষিয়ে দিচ্ছি।’ বলতে বলতে বুকপকেট থেকে ভাঁজ করা একটা কাগজ আমার হাতে তুলে দিলেন কায়সার ভাই। ভাঁজ করা কাগজটা খুলে দেখি, একটা পদ্য। ছোটদের কাগজের জন্য লেখা নতুন একটা পদ্য!
ঝুট-ঝামেলাহীন নিপাট শান্ত প্রকৃতির সজ্জন ব্যক্তি ছিলেন আবু কায়সার। নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে সাহিত্যচর্চা করেছেন। অনাদর-অবহেলা আর অবজ্ঞার শিকার হয়েছেন পদে পদে।
নির্বিরোধী নিভৃতচারী এবং প্রচারবিমুখ মানুষটি অসৎ জীবন যাপন করেননি। অনটনও তাঁর পিছু ছাড়েনি। ইত্তেফাক, গণকণ্ঠ, সংবাদ, ভোরের কাগজ, যুগান্তর কিংবা সাপ্তাহিক বিচিত্রা ছিল তাঁর কর্মক্ষেত্র। তাঁর সহকর্মীরা সবাই স্বীকার করবেন। তিনি ছিলেন অনুচ্চকণ্ঠ সদালাপী ও বন্ধুবৎসল সরল একজন মানুষ।
আমার পরম সৌভাগ্য, ছোটদের কাগজে সম্পাদনা করতে গিয়ে পেয়েছি তাঁর অকুণ্ঠ সহযোগিতা। ছড়া-কবিতা ছাড়াও আমার জবরদস্তিমূলক আচরণে কাবু হয়ে বাংলাদেশের শিশু-কিশোরের জন্য ছোটদের কাগজে তিনি লিখেছিলেন তিন-তিনটি উপন্যাসইনকা রাজার গুপ্তধন, কাফ্রির কাটা হাত এবং পাতাল পিশাচ। তিনটি উপন্যাসই পাঠকপ্রিয় হয়েছিল।
আমি খুব লাল একটি গাড়িকে, জাদুঘরে প্রজাপতি, জ্যোৎস্নায় মাতাল জেব্রাগুলো লিখে আধুনিক কবিতার অঙ্গনে কিংবা রায়হানের রাজহাঁস, কাকতাড়ুয়া, দোয়েলের দেশ লিখে শিশুসাহিত্যের অঙ্গনে আবু কায়সার নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একজন শক্তিমান ও বিশুদ্ধ লেখকের সম্মানজনক আসনে। আজ কবি ও শিশুসাহিত্যিক আবু কায়সারের ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁকে আমার বিনম্র শ্রদ্ধা।
লুৎফর রহমান রিটন

No comments

Powered by Blogger.