তানভীরের ‘একাত্তর’-সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মেহেদী মাসুদ

তানভীর মোকাম্মেলের ১৯৭১ প্রামাণ্যচিত্রটিতে দেখা গেছে মুক্তিযুদ্ধের অনেক অজানা কাহিনি। ছবিটি নিয়ে তাঁর অনুভূতি, অভিজ্ঞতার কথা তিনি জানালেন আনন্দকে। তানভীর ভাই, ১৯৭১ প্রামাণ্যচিত্রটির কাজ করার সময় কোনো সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে কি আবেগ্লাপুত হয়েছিলেন? এমন দুটি ঘটনা কী বলবেন?

বেশ কয়েকবারই এ রকমটি ঘটেছে, বিশেষ করে গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষেরা যখন শরীরের আঘাতচিহ্ন দেখিয়ে মা-বাবা-ভাইবোন বা বন্ধুদের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা বর্ণনা করছিলেন কিংবা ধর্ষিত নারীরা তাঁদের করুণ সব অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন, তখন আমরা খুবই আবেগায়িত হয়েছিলাম।
দুটি ঘটনার কথা বলি। ডুমুরিয়ার চুকনগর গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া নারী-পুরুষেরা, যা আমার ধারণায়, এক দিনে এক জায়গায় ১৯৭১-এর সবচেয়ে বড় গণহত্যা তো বটেই, হয়তো পৃথিবীরই সবচেয়ে বড় গণহত্যার একটি উদহারণ। তো, সেই গণহত্যার বিবরণ যখন বেঁচে যাওয়া কোনো নারী বা পুরুষ দিচ্ছিলেন, যাঁদের সবচেয়ে আপনজনদের তাঁরা চোখের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে অসহায়ের মতো মারা যেতে দেখেছেন। তখন আমাদের পক্ষে আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছিল।
এ ছাড়া কুষ্টিয়া ও সিরাজগঞ্জের গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র নারীরা যখন পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা তাঁদের ধর্ষণ ও লাঞ্ছনার কথা এবং সেই ঘটনা পরবর্তীকালে তাঁদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে কত বড় বিপর্যয় ডেকে এনেছিল এসব বলছিলেন, সেসব অসহায় নারীর কথা শোনার সময়ও আমাদের পক্ষে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা শক্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু যেহেতু আমাদের অভিজ্ঞতা ও পেশাদারি রয়েছে, ফলে তার মধ্যেও আমরা হয়তো নীরবে শুটিংটা করে যেতে পেরেছি, তবে কাজটা বেশ কঠিন ছিল।
যাঁরা মিলনায়তনে বসে ছবিটি দেখেছেন, তাঁদের মন্তব্যগুলো কি আপনাকে এ ধরনের আরও কাজ করতে অনুপ্রেরণা জোগায়?
খুবই। ছবি চলার সময় কোনো বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে মিলনায়তন থেকে দর্শকেরা যখন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন বা স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রশংসাসূচক বাক্য বলে ওঠেন, তখন তা আমাদের খুবই অনুপ্রাণিত করে। ছবির শেষে অনেক দর্শকই আমাদের তাঁদের ভালো লাগার অনুভূতিটা জানিয়েছেন। বলেছেন, ছবিটা সারা দেশে দেখানো উচিত, বিশেষ করে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছবিটা দেখানো উচিত। ছবিটি সারা দেশে চালানোর ক্ষেত্রে দর্শকেরা আমাদের নানারকম পরামর্শ দেন। এসব আমাদের খুবই অনুপ্রেরণা জোগায়।
একাত্তর নিয়ে আপনার ব্যক্তিগত একটি স্মৃতির কথা বলুন, যা এ প্রজন্মের তরুণদের জানা দরকার।
অনেক অভিজ্ঞতাই তো রয়েছে! একটির কথা বলি। ১৯৭১-এর আগস্ট। খুবই বিষণ্ন একসময়। আমি তখন খুলনা শহরে আমাদের পারিবারিক বাড়িতে থাকি। একাত্তরে ওই সময়েও কিন্তু বিয়েশাদি হতো। একটি পরিবার, তারা আবার কিছুটা পাকিস্তানপন্থী, তাদের মেয়ের বিয়ের আয়োজন করেছিল। মেয়েটি আমাদের বোনদের খুব পরিচিত ছিল বিধায় বিয়েটাতে ওদের যেতে হয়েছিল। যুদ্ধের কারণে বাড়ির ড্রাইভারটি তখন লাপাত্তা। ফলে আমাকেই গাড়ি চালিয়ে বোনদের বিয়েবাড়িতে নিয়ে যেতে হয়েছিল। আমার তেমন কিছু করার ছিল না। কেবল অপেক্ষা করা ছাড়া। এমন সময় শুনি বেশ হইচই। সব লোক ছুটে দোতলার বারান্দায় যাচ্ছে। কারণটা কী? যা শুনলাম তাতে আমি বিস্মিত ও চরম ব্যথিত হয়েছিলাম। পাশের বাড়িটি ছিল খুলনার এক কুখ্যাত মুসলিম লীগারের বাড়ি। সে বাড়িতে একটি হিন্দু তরুণী মেয়েকে গ্রাম থেকে ধরে আনা হয়েছে। মেয়েটাকে পরের দিন পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। মেয়েটাকে আমিও দেখলাম। মেয়েটার নাম ‘শান্তি’। পাশের বাড়িটার বন্ধ এক ঘরে জাল লাগানো জানালার পেছনে একটা বিষণ্ন মুখ। বিয়েবাড়ির উজ্জ্বল আলোর দিকে তাকিয়ে আছে! বিষয়টা আমাকে খুবই নাড়া দিয়েছিল। বিষয়টা নিয়ে পরে আমি একটা ছোটগল্পও লিখেছিলাম।
যেটা বলার তা হচ্ছে, ১৯৭১ সাল তো কেবল একটা সশস্ত্র যুদ্ধ ছিল না, এটা ছিল এক গভীর মানবিক বিপর্যয়ের কালও, যখন লাখ লাখ পরিবার ও মানুষের জীবনে গভীর ও করুণ সব ট্র্যাজেডি নেমে এসেছিল। একজন সংবেদনশীল শিল্পী হিসেবে যুদ্ধের চেয়ে এই মানবিক ট্র্যাজেডিগুলোই আমাকে বেশি তাড়িত করে।
নতুন প্রজন্ম আমাদের প্রজন্ম থেকে অনেক বেশি তথ্য পাচ্ছে। এটা কি তাদের মানসগঠনে কোনো ছাপ ফেলছে?
বিশ্বজুড়ে যে তথ্যবিপ্লব ঘটে চলেছে তার ফলে ইন্টারনেট বা অন্যান্য উৎস থেকে এ প্রজন্মের তরুণেরা এখন অনেক তথ্য পাচ্ছে। তবে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার তো কোনো বিকল্প নেই। তা ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কিছু ভুল ধারণা, বিকৃত ইতিহাস প্রচারিত হয়ে এসেছে। তরুণেরা সেসব দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছে, হচ্ছে। তাই এটা জরুরি যে যাঁরা ১৯৭১ সালকে স্বচক্ষে দেখেছেন, তাঁদের সঙ্গে আলাপ করা, সেসব দিনের গল্প বারবার শোনা, যাঁরা ভালো স্মৃতিকথা লিখেছেন, সেসব স্মৃতিকথা মনোযোগ দিয়ে পড়া।
আগে এক সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছিলেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক দেশেই এখনো অনেক ফুটেজ আছে, সেগুলো সংগ্রহ করতে হলে অনেক অর্থের প্রয়োজন। কীভাবে এসব ডকুমেন্টারি ফুটেজ আমরা দেশে আনতে পারি?
এটা রাষ্ট্রীয়ভাবে হওয়া কাম্য। কারণ এর সঙ্গে বড় অঙ্কের অর্থ ও কিছু বড় সিদ্ধান্তের প্রশ্ন জড়িত।
১৯৭১ ছবিটার জন্য আমাকে ব্যাপক গবেষণা করতে হয়েছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের আর্কাইভে গিয়ে ফুটেজ দেখতে এবং সম্ভব হলে সংগ্রহ করতে হয়েছিল। যাঁদের কাছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলির ভালো ফুটেজ রয়েছে, সেসব টেলিভিশন কোম্পানি হচ্ছে আমেরিকার সিবিএস টেলিভিশন, এবিসি টেলিভিশন, ইউরোপের বিবিসি, গ্রেনাডা টেলিভিশন, ডাচ টেলিভিশন ইত্যাদি। এ ছাড়া ভারতের এনএফডিসি ও ফিল্ম ডিভিশনের কাছেও ১৯৭১-এর ঘটনাবলির প্রচুর ফুটেজ রয়েছে। আরও অনেক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছেও ১৯৭১-এর দুর্লভ সব ফুটেজ রয়েছে। এ ব্যাপারে একজন বিশেষজ্ঞ হচ্ছেন ডালাসপ্রবাসী বাঙালি গবেষক মাহবুবুর রহমান জালাল। তিনি আমাকেও দুর্লভ ফুটেজের ব্যাপারে অনেক সহায়তা করেছেন। সরকারের উচিত হবে এ ধরনের বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের নিয়ে একটা সেল মতো গঠন করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এসব অমূল্য ফুটেজ উদ্ধার করা। এটা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কর্তব্য। আমার সীমিত আয়ে সেটা সম্ভব নয়।
এই ছবির সংগীত তৈরির সময় কোন দিকটি মাথায় রেখেছিলেন? কিংবা আপনাকে খুব বেশি প্রভাবিত করেছিল?
১৯৭১ ছবিটার সংগীত পরিচালক হচ্ছেন সৈয়দ সাবাব আলী আরজু। ১৯৭১ ছবিটির আবহসংগীত নিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার দীর্ঘ ও অনেক আলাপ হয়েছে। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সাল এবং একটা সফল মুক্তিযুদ্ধের জন্য আমাদের দেশের মানুষের ত্যাগ-তিতিক্ষা ও মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব ও সংগ্রাম—এগুলোই আবহসংগীতের মাধ্যমে অনুরণিত করা আমাদের লক্ষ্য ছিল। সে কারণে আমরা আবদুল লতীফের ওই অমর সংগীতটি ‘আমি দাম দিয়ে কিনেছি এই বাংলা’কে ছবিটার থিম সংগীত হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম, যেখানে আবহমান বাংলার প্রেক্ষিতে ১৯৭১ সাল এবং একটা মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য এ দেশের মানুষের ত্যাগ-তিতিক্ষার বিষয়টি সাউন্ডট্রাকে শিল্পিতভাবে ফুটে ওঠে।

No comments

Powered by Blogger.