একাত্তরে ববিতা

মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস কেমন ছিলেন ববিতা? সে কথাই জেনে নিই তাঁর বয়ানে। তখনো যুদ্ধ শুরু হয়নি। ৭ মার্চের পরপর সবকিছুরই কেমন যেন পরিবর্তন হতে লাগল। জহির ভাই এক দিন বাসায় বলছিলেন, ‘বেটারা সহজে দেশটাকে বোধ হয় ছেড়ে যাবে না।’

একেকটি দিন গেছে, আর প্রতিদিনই কোনো না কোনো খবর আসত। অবশেষে এল ২৫ মার্চের কালরাত। কী যে অসহায় এক অবস্থা হলো, কী করে বোঝাই!

২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর
একাত্তরের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। এর মধ্যেই দু-একটি সিনেমায় অভিনয় করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলাম। সেগুলোর কাজ বন্ধ হয়ে গেল। সুচন্দা আপা, জহির ভাই তখন দিলু রোডের বাসায়। জহির ভাইকে কলকাতায় চলে যেতে হবে। তিনি আপাকে আমাদের গেন্ডারিয়ার বাড়িতে রেখে চলে গেলেন। কিছু আর্মি অফিসার এসে ‘বেবিটা কোন হে, বেবিটা কোন হে’ এমন করে খোঁজ করছিল। গেন্ডারিয়ার বাড়িতে ছিল বিশাল এক গেট। আমরা দোতলায় থাকতাম। বাবা থাকতেন নিচতলায়। যে-ই গেটের আওয়াজ পেতাম—তখন আমাদের বাড়ির পেছন দিকে একটা দরজা ছিল—গলির ভেতর দিয়ে পাশের বাড়ি দিয়ে এদিক-ওদিক চলে যেতাম। আমি, চম্পা, বাবা, কাজের লোক—সবাই এভাবে লুকিয়ে থাকতাম। দিন দিন এর মাত্রা বেড়ে গেল। ফিল্মের আর্টিস্টদের বাড়িতে গিয়ে খোঁজ করত তারা। সুভাষ দত্ত, আনোয়ার হোসেনসহ আরও অনেককেই খোঁজা হচ্ছে বলে জানতে পারলাম। আমাকে হয়তো পাওয়া গেলে তারা তুলেই নিয়ে যেত—এটাই স্বাভাবিক। একটা সময় পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হলো যে কিছুতেই আর ওখানে থাকা নিরাপদ মনে হলো না। তখন আমরা মেজর মোস্তফা নামের একজন পাকিস্তানি আর্মি অফিসারের খোঁজ পেলাম। তাঁকে একেবারে বাঙালিই বলা যায়। তাঁর বউয়ের নাম বানু। তিনি আবার কাজী জহিরের দু-একটি সিনেমায় শখের বশে অভিনয় করেছিলেন। তখন তাঁরা ক্যান্টনমেন্টের একটি বাড়িতে ফিল্মের অনেককেই আশ্রয় দিলেন। সেখানে দেখলাম কাজী জহিরের পুরো পরিবার। তাঁর বউ হিন্দু ছিলেন, তাই আরও ভয় ছিল। নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই আসলে আমরা মেজর মোস্তফার বাড়িতে যাই। তার ওপর আবার জহির ভাই কলকাতায় গেছেন, এটা জানাজানি হওয়ার পর আরও সমস্যা দেখা দিয়েছিল। প্রায়ই পাকিস্তানি আর্মি এসে বাবাকে প্রশ্ন করে, ‘তোমারা দামাতজি ভারত মে চল গিয়া?’ সে জন্য বাবাও চিন্তা করে আমাদের বাড়িতে রাখেননি। তখন আমরা সবাই—কাজী জহির, তাঁর বউ, এমনকি দু-চারজন টেলিভিশনের শিল্পীসহ ক্যান্টনমেন্টে মেজর মোস্তফার বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। আমরা সেখানে বসে নৌকা বানাই, জয় বাংলাও বলি—সব। বাড়ির বাইরে বেরোতাম না। বাড়ির ভেতর রান্না করছি, খাচ্ছি। সেখান থেকে সুচন্দা আপা যখন ভারতের উদ্দেশে রওনা হবেন, তখন মেজর মোস্তফা আমাদের সাহায্য করলেন। তিনি লিখে দিলেন, ‘সুচন্দা পাক্কা মুসলমান হ্যায়’ এবং কার্ড ঝুলিয়ে দিলেন। এভাবে আপা বর্ডার পর্যন্ত পৌঁছান। এরপর পরিস্থিতি যখন একটু ঠিক হলো, মানে যখন মেয়েদের উঠিয়ে নেওয়াটা বন্ধ হলো, আমরা স্বস্তি পেলাম। তারাও বুঝতে পারল যে দেশ স্বাধীন হবে। তখন মেজর মোস্তফাকে আবার পাকিস্তানে চলে যেতে হবে। দেশ স্বাধীনের একটা আঁচ কোনোরকম বোঝা যাচ্ছিল। পাকিস্তানি আর্মিদের কাণ্ডকারখানা দেখে বোঝা যাচ্ছিল, কী জানি একটা হতে যাচ্ছে! তখন মেজর মোস্তফা বললেন, ‘তুম লোক্কা কোভি ডর নেহিয়ে, তুম লোক ঠিক হে, আরামছে যাও।’ তিনি আরও বললেন, ‘কেউ তোমাদের কোনো ক্ষতি করবে না। কেউ যদি ক্ষতি করতে আসে, তোমরা আমার নাম বলবে, আমার লেখা চিঠি দেখাবে।’ বানু ভাবিও চলে গেলেন পাকিস্তানে। আবার গেন্ডারিয়ায় ফিরে গেলাম। যদি কেউ ক্ষতি করতে আসত, তবে মেজর মোস্তফার চিঠি দেখাতাম। ভয়ে স্যালুট দিয়ে চলে যেত। এর মধ্যে সুচন্দা আপার কোনো খবর পাচ্ছি না। আমাদেরও কোনো খবর পান না তাঁরা। মুক্তিবাহিনীর দু-একজন আমাদের কারও হাতে একটা চিঠি পাঠিয়েছেন। ‘ভালো আছি, বেশি কিছু জানতে চেয়ো না। জহির ভাইয়ের খবর মোটামুটি। আমরা একটু কষ্টে আছি’—এ রকম দু-এক লাইনের মধ্যে বুঝিয়ে দিতেন। চিঠি আবার কারও হাতে পড়লে বিপদও হতে পারে। এভাবে চলতে লাগল। দেশ স্বাধীন হলো। জহির ভাই চলে এলেন।

No comments

Powered by Blogger.