প্রতিক্রিয়া-আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মিল-গরমিল by এ কে এম শাহাবুদ্দিন

সোহরাব হাসান গত ১৬ এপ্রিল ‘আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মিল-অমিল’ শিরোনামে লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগের জন্ম আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতরে আর বিএনপির জন্ম সেনানিবাসে, সামরিক শাসকের তত্ত্বাবধানে।’ এ বিষয়ে আমি বলতে চাই যে আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছিল মওলানা ভাসানীর হাতে, কোনো আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে নয়।

জন্মের পরপরই আওয়ামী লীগ গণবিরোধী চক্রের হাতে পড়ে। ফলে বাধ্য হয়ে আওয়ামী লীগের জনক আওয়ামী লীগকে ত্যাজ্য করে ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ নামে নতুন দল গঠন করেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা পায় ১৯৭১ সালের পরে। সে সময়ে দলটির জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। কিন্তু ধোঁকাবাজির বিশ্ব রেকর্ড দিয়ে গড়া এ জনপ্রিয়তা নিঃশেষ হয়ে যায় মাত্র সাড়ে তিন বছরে। জিয়াউর রহমানের আমলে পুনর্জন্ম লাভ করে আওয়ামী লীগ, জিয়াউর রহমানের ‘বহুদলীয় গণতন্ত্র’ নীতিকে কাজে লাগিয়ে। সুতরাং বর্তমানের আওয়ামী লীগ সৃষ্টি হয়েছে পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পরে গণতান্ত্রিক আবহাওয়ার কারণে এবং একদলীয় সরকারব্যবস্থার ধারক ও বাহক বাকশাল থেকে, কোনোক্রমেই আন্দোলন-সংগ্রামের পটভূমিতে নয়। আরও বহু বাক্যবাগীশের মতো সোহরাব হাসান যে বলেছেন, বিএনপির জন্ম সেনানিবাসে, তা কস্মিনকালেও ঠিক নয়। বিএনপির পূর্ববর্তী আরও একটি দল ছিল, যার নাম জাগদল। এ দলে সেনানায়কেরা কর্ণধার ছিলেন না। এটির হেড অফিসও সেনানিবাসে ছিল না। সোহরাব হাসান সেনাবাহিনীর প্রতি যে বিরূপ মনোভাব ব্যক্ত করেছেন, সে জন্য তাঁর অনুতপ্ত হওয়া উচিত। কারণ সেনাবাহিনী এ দেশেরই একটি অংশ। সাতজন বীরশ্রেষ্ঠর সবাই সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন। দেশের দুর্দিনে এগিয়ে আসার জন্যই তো সেনাবাহিনী। জিয়াউর রহমান একজন জেনারেল হয়েও দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের ভিত পুনরায় রচনা করেছিলেন।
দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে যে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের জন্ম এবং ইতিহাস-ঐতিহ্য পুরোনো দিনের হওয়ায় তা মানুষ অনেকটা ভুলে গেছে। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে সোহরাব হাসান আর দশজন স্তাবকের মতো সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্রটি তুলে ধরলেন। তবে বর্তমান সরকারের ব্যর্থতার পাহাড় যেহেতু সবাই চাক্ষুষ করছেন এবং এ বিষয়ে লুকোচুরি খেলার কোনো অবকাশ নেই, তাই তিনি তা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। এ ব্যাপারেও তিনি বর্তমান সরকারের কর্তাব্যক্তিদের মতো বিএনপির ঘাড়েই দোষের বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। বর্তমান সরকারের ব্যর্থতার কাহিনি এমনকি মার্কিন মুলুকেও পৌঁছে গেছে, যে জন্য বাংলাদেশ সরকারের বন্ধুরাষ্ট্রের বন্ধু হয়েও তাঁরা এ বিষয়ে বাদ-প্রতিবাদ করছেন। মার্কিনদের এক রিপোর্টে বাংলাদেশে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনের কথা উল্লিখিত হয়েছে। অথচ লেখক আওয়ামী লীগের বর্তমান আমল ও বিএনপির আমলের ব্যর্থতার একটি চিত্র তুলে ধরে আওয়ামী লীগকে জিতিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। সোহরাব হাসান বলছেন যে ‘বিএনপি জঙ্গি তোষণ ও সন্ত্রাস লালন করেছে। পক্ষান্তরে প্রথমটি থেকে আওয়ামী লীগ মুক্ত থাকলেও দ্বিতীয়টি থেকে মোটেই মুক্ত নয়।’ কিন্তু আসল ঘটনা হলো, বিএনপি শায়খ আবদুর রহমান, বাংলা ভাইসহ জেএমবির শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। বিএনপির আমলেই বিচারে এসব জঙ্গির বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় হয়, যা কার্যকর হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে। লেখক বর্তমান সরকারের আমলের সন্ত্রাসকে বিএনপির আমলের সন্ত্রাসের সঙ্গে তুলনা করছেন। অথচ বিএনপির আমলে সন্ত্রাস ঘটেছিল বর্তমান সময়ের চেয়ে অনেক কম। পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ে প্রতিদিনকার ইভ টিজিং, ছিনতাই ও শারীরিক নির্যাতনের করুণ কাহিনি। তাই বলি, বর্তমান আমল এবং বিএনপির আমলের সন্ত্রাসের ঘটনা কি এক?
সোহরাব হাসান বিএনপির পাঁচ বছর আমলের তুলনা করছেন আওয়ামী লীগের সোয়া দুই বছরের সময়ের। তিনি বলছেন, বিএনপির আমলে একজনকে খুনের মামলায় মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করা হয়েছিল এবং বর্তমানে খুনের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মাফ করা হয়েছে শুধু এক নাটোরেই ২১ জনকে। তাহলে বলুন, কার দোষ বেশি। সোহরাব হাসান অনেক উপমা দিয়ে আওয়ামী লীগকে বিএনপির চেয়ে এগিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। তবে তিনি ভারতকে প্রায় বিনা শুল্কে ট্রানজিট প্রদান, বাংলাদেশের বন্দরগুলো ভারতের ব্যবহারের সুযোগ, ভারত থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় প্রভৃতি সম্পর্কে টুঁ শব্দটি করেননি। সম্ভবত এ জন্য করেননি যে, এগুলো সম্পর্কে সাধারণ মানুষ ততটা ওয়াকিবহাল নয়। সোহরাব হাসান বলেছেন, ‘আরেকটি বিষয়ে দুই দলের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট। বিএনপি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেছিল। আওয়ামী লীগের সরকার তাদের বিচার করতে উদ্যোগী হয়েছে।’ এ প্রসঙ্গে বলতে চাই, যুদ্ধাপরাধ কেন, সব অপরাধীর বিচার করাই নিয়ম। আইনের চোখে সবাই সমান। যুদ্ধাপরাধের বিচারের সঙ্গে কেন বাকশাল আমলে সিরাজ শিকদারসহ ৩৫ হাজার দেশপ্রেমিক যুবক হত্যার বিচার হবে না?
বিগত কয়েকটি উপনির্বাচন ও পৌরসভার নির্বাচনে বিরোধী দল সরকারি দলের ব্যাপক সন্ত্রাস ও কারচুপি সত্ত্বেও ভালো রেজাল্ট করেছে। এ অবস্থাকে তিনি সরকারি দলের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে জনগণের রায় ও বিরোধী দলের প্রতি জনগণের আস্থা না বলে বোঝাতে চাচ্ছেন, যেকোনো সরকার ব্যর্থ হলেই জনগণ বিকল্প হিসেবে বেছে নেয় প্রতিদ্বন্দ্বী দলকে। কিন্তু ঝিকে মেরে বউকে শিক্ষা দিচ্ছেন আগামী সাধারণ নির্বাচন নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করে। নিবন্ধের একেবারে শেষে তিনি বলছেন, ‘মধ্য মেয়াদের কাছাকাছি এসে সরকারের সামনে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, তারা পূর্বসূরি বিএনপির পথেই যাবে নাকি বাজার কিংবা শেয়ারবাজার সিন্ডিকেটের লাগাম শক্ত করে বাঁধবে।’ দুই দলের মিল-অমিলের কথা যদি ওঠে, বলতে হয়, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেই শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি হয়; বিএনপির আমলে শেয়ারবাজারে ধস নামেনি। বিএনপির আমলেও এর মূল্য কিঞ্চিৎ বৃদ্ধি পেয়েছিল, তবে বর্তমানের মতো আগুন বরাবর নয়।
এ কে এম শাহাবুদ্দিন: প্রভাষক, জামালপুর কলেজ, গাজীপুর।

No comments

Powered by Blogger.