শহীদ মিনারে তিক্ত অভিজ্ঞতা by নির্মল সেন

১৯৭১ সালের অক্টোবর মাস। আমি যুদ্ধের কারণে আগরতলায়। আমার ছোট ভাই মৃণাল সেন সস্ত্রীক কলকাতার ২৪ পরগনার বারাসাতে গেছে। আমি তখনও বিশ্বাস করি, যুদ্ধে আমাদের জয় হবে। আমি একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বারাসাতে অবস্থানরত আমার ভাইকে লিখেছিলাম_ যুদ্ধে আমাদের জয় হোক আর না হোক আমি শহীদ মিনারে খালি

পায়ে যাব এবং ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাব। দেশ স্বাধীনের পর ৪০ বছর ধরে এই কাজটি আমি করছি। এখন আমি অসুস্থ। তবুও এ বছর হুইল চেয়ারে শহীদ মিনারে যাই ভাষাসংগ্রামীদের শ্রদ্ধা জানাতে। এবার গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে আমি বলেছি, আর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যাব না। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যাওয়া নিয়ে অনেক কষ্ট করেছি। এক সময় শহীদ মিনারে মারামারি, কাটাকাটি হতো। সাংবাদিকদের নিয়ে মিছিল করে শহীদ মিনারে গেলে সবাই থেমে যেত। সে যুগ আর এখন নেই। আমি তেমন করে মিছিল নিয়ে আর শহীদ মিনারে যেতে পারি না। ২৫ মার্চ কালরাত পালন উপলক্ষে শহীদ মিনারে মোমবাতি জ্বালাতে যেতে পারি না। তবুও এ বছর আমার গ্রামের বাড়ি সুদূর গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া থেকে ঢাকা এসে ২০ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে ভাষাসংগ্রামীদের শ্রদ্ধা জানাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যাই। এবার গিয়ে আমার চরম শিক্ষা হয়েছে। এখন যে অবস্থা শহীদ মিনারে হয়েছে তাতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর জন্য সব ঠিক থাকে। এরপর সব এলোমেলো হয়ে যায়। এমনকি বিদেশি রাষ্ট্রদূত ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের জন্য কোনো ব্যবস্থা থাকে না। সব আমলেই এটা হয়ে থাকে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একটা শৃঙ্খলা ছিল। এবারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা তাদের সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে সব তছনছ করে দিয়েছে। ওদিকে ভাষ্যকাররা যাদের নামের তালিকা পেয়েছেন তাদের নাম বারবার ঘোষণা করেছেন। সভ্য জগতে প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা থাকে। আমি হুইল চেয়ার নিয়ে শহীদ মিনারে যাই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মালাও দিতে পারিনি। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি আর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যাব না। নিজের বাড়িতে শহীদ মিনার তৈরি করে সেখানে ভাষাসংগ্রামীদের শ্রদ্ধা জানাব। আমার মনে পরে জেলখানার কথা। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে জেলখানায় অনশন করি। এর আগে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে একাধিক্রমে পরপর ১২৭ দিন অনশন ধর্মঘট করি। '৫২-এর ২২ ফেব্রুয়ারি অনশন করতে গিয়ে আমার মরণাপন্ন অবস্থা। ডাক্তার এসে আমাকে জল খেতে বললেন। আমি রাজি হলাম না। আমার ক্রনিক ক্লোলাইটিস হয়ে গেল। পরবর্তীকালে ডাক্তারের সুপারিশে আমি মুক্তি পাই। আইয়ুব আমলে আমরা জেলে বসে কৌশল করে শহীদ দিবস পালন করতাম। গভীর রাতে কয়েকটি বাক্স একের পর এক রেখে চাদর দিয়ে মুড়িয়ে শহীদ মিনার তৈরি করে ফুল দিতাম। ভোর হওয়ার আগে অনুষ্ঠান শেষ করতে হতো। কারণ জেল কর্তৃপক্ষ জানতে পারলে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিত।
সবচেয়ে ভালোভাবে শহীদ দিবস পালন করেছি এরশাদের আমলে। ২১ ফেব্রুয়ারির আগের দিন জেলার ইসমাইল সাহেব আমাকে ডাকলেন। তিনি বললেন, আপনারা যদি শহীদ দিবস পালন করতে চান তাহলে আমি পুলিশ দেব। আমি বললাম, আপনার পুলিশ লাগবে না। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে শহীদ দিবস পালন করব। তখন বাইরে এরশাদবিরোধী আন্দোলন চলছে। আমরা জেলখানায় ৮ দল, ৭ দল, ৫ দল আলাদা আলাদাভাবে শহীদ মিনারে ফুল দিলাম। ৮ দলের পক্ষে টাঙ্গাইলের আবদুল মান্নান, ৭ দলের পক্ষে আ স ম হান্নান শাহ্, ৫ দলের পক্ষে জাসদ নেতা কাজী আরেফ শহীদ মিনারে ফুল দিলেন। তখন জেলে ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের অনেক সদস্য ছিল। কিন্তু কোনো গোলমাল হয়নি। আজকে শহীদ মিনারে গেলে সেই কথা মনে পড়ে। আমরা সারাজীবন স্বৈরতন্ত্র ও সামরিক ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেছি। বর্তমানে দুই নেত্রী তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিতর্ক করছে। দুঃখের বিষয়, আজ শহীদ মিনারে গিয়ে শুনতে হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই ভালো ছিল। আজকে বড় দুই দলের সাঙ্গপাঙ্গদের মারামারির কারণে মৃত্যু হাতে নিয়ে শহীদ মিনারে যেতে হয়। আমি শেষ জীবনে পদদলিত হয়ে মরতে চাই না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি ২০ ফেব্রুয়ারি
আর একটি কথা_ আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রিত অতিথিদের উন্নতমানের নাশতা দেওয়া হতো। এবার যে নাশতা দেওয়া হয়েছে তা চাঁনখারপুলের দোকানে পাওয়া যায়। আমন্ত্রিত অতিথিরা অভিযোগ করে বলেন, এ নাশতার ব্যবস্থা নিশ্চয়ই ছাত্রলীগ করেছে। আমি দুই নেত্রীকে অনুরোধ করব, আপনারা আপনাদের সাঙ্গপাঙ্গদের সামলান। এবার দেখেছি, অনেকে শহীদ মিনারের মূল বেদিতে উঠে গেছে। আমি কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করব, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির কাছে সব দায়িত্ব দেওয়া হোক। তারা তদারকি করবে। কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ, প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করার জন্য। না হলে প্রতিবন্ধীরা শহীদ মিনারে গিয়ে পদদলিত হয়ে মরতে পারে।

নির্মল সেন : সাংবাদিক ও রাজনীতিক
nirmolsen1930@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.