কলকাতার চিঠি-বামফ্রন্ট উৎখাতে পুরুলিয়ায় অস্ত্রবর্ষণ! by অমর সাহা

সামান্য একটু হলেও ধাক্কা খেল পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস জোট। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন চলার মধ্যেই পুরুলিয়ায় অস্ত্রবর্ষণ নিয়ে ওই মামলার অভিযুক্ত আসামি কিম ডেভির বিস্ফোরক মন্তব্য গোটা নির্বাচনী ময়দান তোলপাড় করে দিয়েছে। যদিও পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী কংগ্রেস-তৃণমূল জোট এ ঘটনাকে তেমন আমল না দিয়ে বরং বলেছে, এখন

বামফ্রন্ট নির্বাচনের পরাজয় এড়াতে নতুন সুর তুলেছে। তৃণমূল নেতারা তো বলেই দিয়েছেন, কালো টাকা নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করার পর এবার সিপিএম কংগ্রেসের পেছনে লেগেছে। আর কেন্দ্রীয় সরকার বা কংগ্রেস নেতারা এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন।
এত কিছুর পরও কিন্তু রাজনৈতিক উত্তাপ কমেনি পশ্চিমবঙ্গে। বরং পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি এই উত্তাপ এখন ছড়িয়ে পড়ছে অন্যান্য রাজ্যেও। সবারই এক কথা—একটি নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করার জন্য এভাবে অস্ত্র বর্ষণ করে রাষ্ট্রপতির শাসন জারির পরিকল্পনা নেওয়ার ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না। তাই তো বাম দলের পাশাপাশি বিজেপিও এ ঘটনার নিন্দা করা থেকে পিছপা হয়নি।
পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন এবার চলছে ছয় দফায়। ইতিমধ্যে তিন দফার নির্বাচন শেষ হয়ে গেছে। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৭৯টি আসনে। ২৯৪ আসনের বিধানসভার এখনো বাকি ১১৫টি আসনের নির্বাচন। সেই নির্বাচন হচ্ছে ৩, ৭ ও ১০ মে। এই তিন দফা নির্বাচনের আগেই গত বৃহস্পতিবার নতুন করে ফাঁস হয়ে যায় পুরুলিয়া অস্ত্রবর্ষণ ঘটনার নেপথ্য রহস্য। তাতে বলা হয়, পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারকে উচ্ছেদ করার জন্য পুরুলিয়ায় অস্ত্র বর্ষণ করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল এতে করে রাজ্যে অশান্তি ছড়ানো, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো। আর সেই সুযোগে রাজ্যপাট থেকে বামফ্রন্টকে সরিয়ে রাজ্যে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করা। এই ঘটনা ফাঁস করার পর ভারতের রাজনীতি উত্তাল হয়ে ওঠে।
ঘটনার সূত্রপাত বৃহস্পতিবার। এদিন ভারতের একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল টাইমস নাও পুরুলিয়ার অস্ত্রবর্ষণ মামলার অন্যতম অভিযুক্ত কিম পিটার ডেভির একটি সাক্ষাৎকার প্রচার করে। ওই সাক্ষাৎকারে পিটার ডেভি পুরুলিয়ায় অস্ত্রবর্ষণ নিয়ে অজানা তথ্য ফাঁস করে দেন। বলেন, পশ্চিমবঙ্গের বাম কমিউনিস্ট সরকারকে পরিকল্পিতভাবে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য পুরুলিয়ার গ্রামে অস্ত্র ফেলা হয়েছিল। আর এই কাণ্ডে সরাসরি জড়িত থাকে তৎকালীন কংগ্রেস সরকার। তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নরসিমা রাও। শুধু তা-ই নয়, কিম ডেভি এ কথাও বলেছেন, এই অস্ত্র ফেলার ঘটনা ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র এবং ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-৫ জানত। কিম ডেভি ডেনমার্কের নাগরিক। রাজধানী কোপেনহেগেন থেকে ভারতীয় টিভি চ্যানেলকে তিনি ওই সাক্ষাৎকার দেন। তিনি বলেন, এই অস্ত্রবর্ষণের সময় পশ্চিমবঙ্গের কলাইকুন্ডায় বিমানবাহিনীর রাডারও বন্ধ রাখা হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, কিম ডেভি আরও বলেছেন, ওই ঘটনার সময় তিনি নিজেও অস্ত্রবর্ষণকারী বিমানে ছিলেন। মুম্বাই বিমানবন্দরে ওই বিমানের পাঁচ লাটভিয়ান বৈমানিকের সঙ্গে তিনিও ধরা পড়লে বিশেষ ব্যবস্থায় তিনি সেখান থেকে পালিয়ে যান। পরে বিহারের সাংসদ পাপ্পু যাদব তাঁর গাড়িতে করে তাঁকে নেপাল সীমান্ত পার করে দেন। পাপ্পু যাদব অবশ্য এখন বিহারের সিপিএমের এক নেতা অজিত সরকারের হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছেন। কিম ডেভি আরও বলেছেন, সিপিএমের সন্ত্রাস ঠেকানোর জন্যই ওই অস্ত্র ফেলা হয়েছিল।
একই সময় লন্ডন থেকে দেওয়া আর একটি সাক্ষাৎকারে ব্রিটিশ অস্ত্র ব্যবসায়ী পিটার ব্লিচ বলেছেন, ‘আমার ধারণা, এটা ভারত সরকারের কাজ। অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল জ্যোতি বসু সরকারের স্থিতি নষ্ট করা এবং পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করা।’ তিনি এ কথাও বলেছেন, ‘প্রথমে বুঝতে পারি, ভারতের কোনো সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের জন্য এই অস্ত্র কেনা হচ্ছে। পরে আমি বিষয়টি অবহিত করি ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-৫ কে।’
এদিকে অস্ত্রবর্ষণের এই খবর টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু, মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যসহ দলের কেন্দ্রীয় নেতারা সোচ্চার হন। তাঁরা বলেন, এবার প্রমাণিত হয়ে গেল, পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারকে গদিচ্যুত করার জন্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের জাল কত দূর বিস্তৃত।
এদিকে এ ঘটনার পর বামফ্রন্ট এখন নির্বাচনী ময়দানে পুরুলিয়ায় অস্ত্রবর্ষণ ঘটনাকে প্রচারের আলোয় নিয়ে এসেছে। তারা জনগণকে বোঝাতে চাইছে, পশ্চিমবঙ্গে বাম সরকারকে গদিচ্যুত করার জন্য আজ বিরোধীরা কতটা তৎপর। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এ ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছেন। বিজেপির কেন্দ্রীয় মুখপাত্র রবিশঙ্কর প্রসাদ বলেছেন, ‘কোনো নির্বাচিত সরকারকে অস্থির করে তুলতে এ ধরনের ষড়যন্ত্র নিন্দাজনক। বাম সরকারের কাজ নিয়ে আমাদের অনেক অভিযোগ আছে ঠিকই কিন্তু এভাবে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা সমর্থন করা যায় না।’
অন্যদিকে শুক্রবার রাজধানী দিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে সিপিএমের কেন্দ্রীয় সম্পাদক প্রকাশ কারাত তিনটি দাবি তুলেছেন—ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত, কিম ডেভির ভারতে প্রত্যর্পণ এবং পাপ্পু যাদবকে জিজ্ঞাসাবাদ।
১৯৯৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর রাতে পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার ঝালদা ও জয়পুর থানার সাতটি গ্রামে ফেলা হয় ওই অস্ত্র। অস্ত্রের মধ্যে ছিল একে-৪৭ রাইফেল, রকেট লঞ্চার, অ্যান্টি-ট্যাংক গ্রেনেড, হ্যান্ড গ্রেনেডসহ প্রচুর গোলাবারুদ। এটি আনা হয়েছিল একটি লাটভিয়ার বিমানে করে। পরে মুম্বাইয়ে এই বিমান জোর করে নামানো হয় এবং গ্রেপ্তার করা হয় ব্রিটিশ অস্ত্র ব্যবসায়ী পিটার ব্লিচসহ বিমানের পাঁচ লাটভিয়ান বৈমানিককে। কিন্তু পালিয়ে যান অস্ত্রবর্ষণ মামলার অন্যতম আসামি কিম পিটার ডেভি ও সত্যেন্দ্র সিং র‌্যান্ডি। পরে আটক এই পাঁচ বৈমানিকসহ ছয়জনের বিচার হয় কলকাতার নগর দেওয়ানি আদালতে। বিচারে ২০০০ সালে ছয়জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।
অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.