খোলা চোখে-এক কালো অধ্যায়ের সমাপ্তি by হাসান ফেরদৌস

ওসামা বিন লাদেন মৃত।’ সামান্য এই কথার ভেতর দিয়ে শেষ হলো সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের এক অধ্যায়। না, সে যুদ্ধ শেষ হলো তা বলছি না। পাকিস্তানে, যার সামরিক ও গোয়েন্দা বাহিনী এত দিন খোদ সেনাছাউনির দেড় হাতের ভেতর আলিশান বাড়ি বানিয়ে, চারদিকে পাহারা বসিয়ে বিন লাদেনকে পেলে-পুষে রেখেছিল, সেখানে খুনে মানুষের অভাব নেই।

ঈশ্বরের নামে সে দেশে প্রায় প্রতিদিনই মানুষ খুন হচ্ছে। বিন লাদেন ঈশ্বর নন, কিন্তু তাঁকে ছোটখাটো একজন দেবতা মানে এমন লোক সেখানে বিস্তর। ইন্টারনেটে পাকিস্তানিদের যে প্রতিক্রিয়া দেখেছি তাতে মনে হয়, শুধু দেশের ভেতর কেন, দেশের বাইরেও তেমন খুনে মানুষের অভাব হবে না। ফয়সল শাহজাদ নামের এক ভদ্রগোছের পাকিস্তানি এই নিউইয়র্ক শহরেই গাড়ির ভেতর বোমা রেখে সটকে পড়তে চেয়েছিলেন। সে বোমা ফুটলে মারা যেত নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষ। তাদের মধ্যে শিশু ও নারীর সংখ্যাই সম্ভবত অধিক হতো। দু-চারজন মুসলমানও হয়তো মারা যেত।
যাঁরা বিন লাদেনকে দেবতা ভাবেন, তাঁদের উদ্দেশে বলছি, এই লোকটি আমেরিকাকে শায়েস্তা করার নামে ঠান্ডা মাথায় তিন হাজার মানুষকে এক দিনে হত্যা করেছেন। আমি পরে ভিডিওতে দেখেছি, সে হত্যাকাণ্ডের সফলতায় তিনি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছেন। খালেদ আল হারবি ও অন্য সহযোগীদের সঙ্গে কথোপকথনে বিন লাদেন বিন্দুমাত্র অনুশোচনা না দেখিয়ে সেখানে বলছেন, শত্রুপক্ষে কত লোক নিহত হবে, তার হিসাব তিনি আগেই করে রেখেছিলেন। লাদেন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রকৌশলী, ফলে সে হিসাব তো তিনি করতেই পারেন। যাঁরা লাদেন-ভক্ত, তাঁদের জানাই, সেদিন যাঁরা মারা যান, তাঁরা প্রায় সবাই ছিলেন খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। টুইন টাওয়ারের একটি রেস্তোরাঁয় কাজ করতেন, এমন কয়েকজন বাঙালিও তাঁদের মধ্যে ছিলেন। তাঁদের একজন ঠিক সেদিনই শিশুপুত্রের জনক হয়েছিলেন। তাঁর বিকেলের শিফটে কাজে আসার কথা ছিল, বিকেলে সন্তান প্রসবের সময় নিজে থাকবেন—এই ভেবে কাজের শিফট বদল করে সকালে এসেছিলেন। তাঁর আর নিজের পুত্রকে দেখার সুযোগ হলো না। সে পুত্রও তাঁর পিতাকে কোনো দিন দেখার সুযোগ পায়নি। আরেক শিশু, তখন তার বয়স তিন। টুইন টাওয়ারের হামলায় তার পিতাকেও হারিয়ে ছিল। আমি জানি, পিতার মৃত্যুর অনেক দিন পর্যন্ত কলবেলের আওয়াজ পেলে সে ছুটে আসত, ভাবত এই বুঝি বাবা এলেন। না, বাবা আর ফিরে আসেননি।
মনে পড়ছে, টুইন টাওয়ার ধ্বংসের তিন দিন পর ম্যানহাটনে আরমারি নামে পরিচিত একটি প্রদর্শনী কেন্দ্রের বাইরে খোলা রাস্তার পাশে একটি অস্থায়ী তথ্যকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। নিহত, আহত বা নিরুদ্দেশ মানুষের খোঁজ নেওয়ার সেটাই ছিল প্রধান ঠিকানা। হাজার হাজার মানুষ সেখানে জড়ো হয়েছিল। সবাই জানতে চায় নিরুদ্দেশ স্বজনদের কোনো হদিস কেউ জানে কি না। কোনো পিতা বা মাতা তাঁর সন্তানের ছবি ঝুলিয়ে রেখে জানতে চাইছেন কেউ তাকে দেখেছে কি না। স্ত্রী অথবা ভাইয়ের ছবি, নিচে ফোন নম্বর, সঙ্গে আকুল আবেদন, কেউ যদি কোনো খবর দিতে পারেন। আমার মনে পড়ছে একটি স্বল্প পরিচিত বাঙালির ছবি। টুইন টাওয়ারে কম্পিউটার প্রোগ্রামার হিসেবে কাজ করতেন ভদ্রলোক। ৯/১১-এর পর থেকে তাঁর কোনো খোঁজ নেই। চারদিকে হাজার হাজার মোমবাতি, বাতাসে জ্বলছে, নিভছে। তারই ফাঁকে সেই ছবি, ঠিক নিচে কাঁপা কাঁপা হাতে একটি ছেলে ও একটি মেয়ের লেখা কয়েকটি শব্দ—ড্যাডি, উই মিস ইউ। প্লিজ, কাম ব্যাক।
বিন লাদেন নিহত হয়েছেন, এ খবর শুনতে পেয়ে আমার সেই বালক ও বালিকার কথা মনে পড়ল। আমার মনে প্রায় অসম্ভব এক আশারও জন্ম হলো। হয়তো এই মৃত্যুর ভেতর দিয়ে তাদের নিজেদের পিতার মৃত্যু-ঘটনার সমাপ্তি অর্জিত হবে। যে তিন হাজার নারী-পুরুষ নিউইয়র্কে ৯/১১ তারিখে নিহত হয়েছিলেন, তাঁদের স্বজনদের অনেকেই এই সমাপ্তি বা ক্লোজারের কথা বলেছেন।
মুসলিম বিশ্বে অনেকেই বিন লাদেনকে একজন বড় ধরনের বিপ্লবী ভেবে থাকেন। বিপ্লব বলতে আমরা সাধারণত বুঝি পুরোনোকে ভেঙে নতুনের পথে এগোনো। কিন্তু তিনি এমন এক বিপ্লবী, যিনি বর্তমানকে ভেঙে পেছনে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। সম্ভব হলে চৌদ্দ শ বছর পেছনে। শুনেছি, অ্যাবোটাবাদে তাঁর সুরম্য ভবনে তিনি নশ্বর জগতের তাবৎ সুখ-সুবিধাই ভোগ করতেন, এক টেলিভিশন ছাড়া। ফলে আরব-মুসলিম বিশ্বে কয়েক মাস ধরে যে অভাবনীয় পরিবর্তনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, তার কতটুকু তিনি জানতেন, তা বলা মুশকিল। জেনে থাকলে তিনি সম্ভবত এই ভেবে বিষণ্ন হয়েছিলেন নতুন ও পরিবর্তিত যে মুসলিম বিশ্ব, সেখানে কেউই তাঁর বিপ্লবের ডাকে সম্মোহিত হয়নি। বরং ঠিক উল্টো, যে গণতন্ত্র বিষয়টাকে তিনি দুচোখে দেখতে পারতেন না (কারণ, গণতন্ত্র পশ্চিম থেকে আমদানি করা ধারণা, তিনি যে কঠোর নিয়মতান্ত্রিক ধর্মবিশ্বাসের অনুসারী ছিলেন, গণতন্ত্র তার সম্পূর্ণ বিপরীত), আরব বিশ্বের মানুষ সেই গণতন্ত্রের নামেই রাস্তায় নেমে এসেছে। গণতন্ত্রের একটা অর্থ সব মানুষের কথা বলার ও নিজের মত প্রকাশের অধিকার, এমনকি সে কথা বা মত যদি ‘নেতা’র প্রদর্শিত পথ ও মতের সম্পূর্ণ বিপরীতও হয়। যে পরিবর্তনের দাবি আরব বিশ্বের মানুষ করেছে, তাতে ধর্মকে রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে বিযুক্ত রাখার ইচ্ছাই প্রকাশ করা হয়েছে। আরও ভয়াবহ কথা হলো, এই দাবি নিয়ে ছেলেমেয়ে সবাই রাস্তায় নেমে এসেছে। সবার দাবি সমানাধিকারের।
তাঁর মতামতের ওপর যদি নির্ভর করত, তাহলে বিন লাদেন কখনোই এমন পরিবর্তন সমর্থন করতেন না। সে পরিবর্তন ঠেকাতে দরকার হলে রক্তপাতেও তাঁর আপত্তি থাকত না। পাকিস্তানে তাঁর অনুসারীরা তো এক দশক ধরে সে চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছে। বস্তুত, বিন লাদেনের মৃত্যুর পরও পাকিস্তানে একাধিক রক্তপাতের ঘটনা ঘটেছে, যার পেছনে আল-কায়েদা ও তালেবানদের হাত রয়েছে বলে জানানো হয়েছে। পেশোয়ারের কাছে চারসাদাতে চারজন পুলিশকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। একই শহরে ন্যাটোর একটি জ্বালানি গাড়ির ওপর হামলা চালালে এক নারী ও তাঁর তিন শিশুসন্তান নিহত হয়। করাচির হেরাল্ড পত্রিকার মাদিয়া সাত্তার মন্তব্য করেছেন, পাকিস্তানে যত খুনোখুনির ঘটনা ঘটে, তার সব হয়তো আল-কায়েদা বা তালেবানের নয়, কিন্তু এ ঘটনা দুটির দায়িত্ব পাকিস্তানি তালেবান নিজেরাই স্বীকার করেছে।
সন্দেহ নেই, এমন অনেক লোক আছেন, যাঁরা বিন লাদেনকে মনে করেন আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত একজন মস্ত সেনাপতি। আমেরিকাকে কষে গাল দিতে ভালোবাসেন এমন লোক বাম ও ডান উভয় মহলেই বিস্তর। তাঁদের উভয়ের জন্যই বিন লাদেন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীকী অর্থ বহন করে। ডানদের কথা ছেড়ে দিই, তাঁরা যুক্তি নয়, বিশ্বাস থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে থাকেন। কিন্তু বাম মহল, যাঁরা ভাবাবেগের বদলে যুক্তির ওপর জোর দিয়ে থাকেন, তাঁদের ভেতরও এমন লোকের অভাব নেই, যাঁরা লাদেনের ঘাড়ে বন্দুক রেখে আমেরিকার বিরুদ্ধে ঘোড়া ছোটাতে চান। এই ঘোড়দৌড়ের ফলে আমেরিকার কী ও কতটুকু ক্ষতি হয়েছে জানি না, কিন্তু অনেক মুসলিম দেশের নাভিশ্বাস ওঠার দশা হয়েছে। এক পাকিস্তানে তালেবানদের হাতে নিহত হয়েছে এমন মানুষের সংখ্যা কম করে হলেও ৩০ হাজার। এর বাইরে রয়েছে শিয়া-সুন্নি খুনোখুনি, যার পেছনেও জেহাদি জোশ কম দায়ী নয়। বাংলাদেশেও জেহাদি উত্থানের চেষ্টা হয়েছিল, সে ভয় এখনো একদম উবে যায়নি। অথচ আমেরিকাকে ঠেকানোর সবচেয়ে ভালো পথ হলো গণতান্ত্রিক আন্দোলন। যে ‘আরব বসন্ত’ মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার এক বিশাল এলাকাজুড়ে জেগে উঠছে, তার একটা প্রধান লক্ষ্যই এমন এক সরকার গঠন, যা আমেরিকার তাঁবেদার হয়ে থাকবে না। একটা গুলি না ছুড়েও তিউনিসিয়া ও মিসরের যুবকেরা সেই আশ্চর্য বিজয় অর্জন করেছে। এখন যা দরকার সবচেয়ে বেশি তা হলো, এই গণতান্ত্রিক উত্থানকে সমর্থন দেওয়া, যেভাবে সম্ভব তাকে আগলে রাখা।
বিন লাদেন গেছেন, ফলে আল-কায়েদাও গেল, এ কথা আমি বলি না। তবে তার পালের গোদা গেছেন, ফলে ঝাঁকুনি সে খাবেই। লাদেনের ঘটনা থেকে স্পষ্ট, এই জেহাদি আন্দোলন এত দিন টিকে আছে তার প্রধান কারণ পাকিস্তান। সে দেশের সেনাবাহিনী নিজেদের কৌশলগত কারণে লাদেনকে পাহারা দিয়েছে ও জেহাদি আন্দোলনকে মদদ জুগিয়েছে। তারাই যে লাদেনের রক্ষক, আল-কায়েদাপ্রধানের মৃত্যুর ভেতর দিয়ে সেই সত্য এখন প্রমাণিত। ‘কই, আমরা তো জানতাম না লাদেন আমাদের নাকের ঠিক নিচে বাসা বানিয়ে বাস করছিল’, এ কথা বলে তাদের পক্ষে পার পাওয়া অসম্ভব। আর সে কথা যদি সত্য হয়, অর্থাৎ চোখের সামনে লাদেনকে দেখেও তাঁকে যদি না দেখে থাকে, তাহলে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বা গোয়েন্দা বিভাগের দক্ষতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এই দুইয়ের যেটাই হোক, সন্দেহ নেই, আমেরিকা এবার পাকিস্তানের লেজ ধরে টান দেবে, চাই কি টুঁটি চেপেও ধরতে পারে। আমার আশা, এর ফলে আর কিছু না হোক জেহাদি নেটওয়ার্কগুলো তাদের মাথার ওপর ধরে রাখা ছাতা হারাবে।
বিন লাদেনের মৃত্যুতে আনন্দ করার সেটাই হবে একমাত্র কারণ।
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.