অধিকার-মে দিবস ও বাংলাদেশের শ্রমিকশ্রেণী by ওয়াজেদুল ইসলাম খান

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে শ্রমিকশ্রেণী তথা শ্রমজীবী মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। সেই ধারাবাহিকতায় শ্রমিকশ্রেণীর সবচেয়ে বড় উৎসব মহান মে দিবস অধিকার প্রতিষ্ঠা, পারস্পরিক সংহতি প্রকাশ এবং শোষণহীন সমাজ গড়ার শপথের দিন হিসেবে পালনের কথা।

কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, শ্রমিক-কর্মচারীরা দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে যতটুকু অধিকার অর্জন করেছিল, বর্তমানে তার অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত। যেমন—শ্রমিক-কর্মচারীদের একটি বড় অংশ এখনো ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার থেকে বঞ্চিত। বঞ্চনা আছে সরকারি কর্মচারী, কৃষি, গৃহশ্রমিকসহ অন্য অনেক সেক্টরে। পোশাক কারখানার শ্রমিকদের সংগঠন করার অধিকার থাকলেও প্রকৃতপক্ষে মালিকেরা শ্রমিকদের সংগঠন করার ব্যাপারে বিভিন্নভাবে বাধা সৃষ্টি করেন। আইএলও কনভেনশন ’৮৭ ও ’৯৮-এর ভিত্তিতে এবং ’৬৯-এর আইআরও অনুযায়ী পছন্দমতো নেতা নির্বাচন করা তো দূরের কথা, অবসরপ্রাপ্ত ও চাকরিচ্যুত সাবেক শ্রমিক-কর্মচারীদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে শ্রমজীবী তথা শ্রমিকেরা যে প্রত্যাশা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, প্রকৃতপক্ষে তার কোনো প্রত্যাশাই পূরণ হয়নি। স্বাধীনতার মাধ্যমে ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে কিন্তু যে শ্রমিক-কর্মচারীরা স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রাণ দিলেন, তাঁদের স্বপ্ন পূরণ হয়নি বরং পুঁজিবাদী আগ্রাসনে শ্রমিকেরা শোষণ-বঞ্চনার সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছেন। পাশাপাশি দেশ এক কঠিন মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে। স্বাধীনতার আগে একজন শ্রমিক শিল্পনগরে আট ঘণ্টা শ্রমের বিনিময়ে মাসিক মজুরি পেতেন ১২৫ টাকা, যে টাকা দিয়ে তদানীন্তন আমলে প্রায় পাঁচ মণ চাল কেনা যেত। আর এখন যে মজুরি দেওয়া হয়, তা দিয়ে পাঁচ মণ চাল তো দূরের কথা, দুবেলা দুমুঠো অন্নের সংস্থান হয় না। স্বাধীনতার আগের বেতনবৈষম্য তেমন উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল না। তখন জাতীয়ভাবে ব্যক্তিমালিকানা-নির্বিশেষে শিল্পনগরের শ্রমিকদের জন্য মাসে ১২৫ টাকা, অশিল্পনগরের জন্য ১১৫ টাকা এবং তদানীন্তন রাজধানী করাচির জন্য ১৪০ টাকা জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারিত ছিল। এখন শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে বেতন-মজুরিবৈষম্য দূর করার জন্য মালিকানা-নির্বিশেষে বাঁচার মতো জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের জন্য বিগত দুই দশক হলো আন্দোলন চলছে কিন্তু সমাধান নেই। দৈনিক নামমাত্র ৫০-৬০ টাকার বিনিময়ে অনেক শ্রমিক কাজ করতে বাধ্য হন। বেতন ও মজুরির ক্ষেত্রে চরম বৈষম্য বিরাজ করছে। এমনকি ব্যক্তিমালিকানাধীন পাটশিল্পের শ্রমিকেরা এখনো ১৯৮৫ সালে নির্ধারিত ৪৬০ টাকা বেসিক মজুরির ভিত্তিতে বেতন পাচ্ছেন। দীর্ঘ ২৫ বছরেও মজুরি বৃদ্ধি পায়নি, অথচ ইতিমধ্যে জিনিসপত্রের দাম কয়েক গুণ বেড়েছে। এমতাবস্থায় শ্রমিকেরা অর্থনৈতিক শোষণের বেড়াজালে আবদ্ধ।
শ্রমিক-কর্মচারীরা যেহেতু উৎপাদন-প্রক্রিয়ায় একটি মূল উৎপাদক শক্তি হিসেবে কাজ করেন, সেখানে তাঁদের জন্য বাঁচার মতো মজুরি এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। তাই শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ) থেকে বর্তমান বাজারদরের সঙ্গে সংগতি রেখে পাঁচ হাজার টাকা জাতীয় ন্যূনতম মজুরির দাবি তোলা হয়েছে।
মুক্তবাজার অর্থনীতিতে জিনিসপত্রের দাম রোধ করা মুশকিল এবং শ্রমিকের প্রকৃত মজুরি কমে যায়। তাই প্রকৃত মজুরি যাতে কমে না যায়, সে জন্য প্রয়োজন সামাজিক বেষ্টনী। আমরা মনে করি, এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ভেরিয়েবল ডিএ প্রথা চালু এবং রেশন প্রথা চালু করে চাল, ডাল, তেলসহ সস্তা ও বাঁধা দরে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহ করা।
শ্রমিক-কর্মচারীদের চাকরির নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা নেই। আজও আইএলও ’৮৭ এবং ’৯৮-এর ভিত্তিতে শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার বাস্তবায়িত হয়নি। পোশাক কারখানা, চাতালসহ ব্যক্তিমালিকানাধীন শ্রমিকদের আইনগত বাধা না থাকলেও ছলে-বলে-কৌশলে শ্রমিক-কর্মচারীদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার হরণ করা হচ্ছে। মালিকদের খামখেয়ালিপনায় শ্রমিক ছাঁটাই-নির্যাতন অহরহ চলছে। বন্ধ কলকারখানা চালু করার ঘোষণা দিলেও এখনো সেগুলো বন্ধ রয়ে গেছে। দেশে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য শিল্প গড়ে উঠছে না। বেকারত্বের হার দিন দিন বেড়ে চলছে। বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির শতকরা ৮০ ভাগের বেশি শ্রমিক অপ্রাতিষ্ঠানিক সেক্টরে কাজ করছেন। এসব অপ্রাতিষ্ঠানিক বা অসংগঠিত শ্রমিকদের দিয়ে নামমাত্র মজুরিতে কাজ করানো হচ্ছে। তাঁদের নিয়োগপত্র দেওয়া হয় না। ছুটির বিধান নেই, নিয়ম অনুযায়ী ওভারটাইম দেওয়া হয় না। নারী-পুরুষনির্বিশেষে সমাজে সমমজুরি দেওয়া হয় না। পথে-ঘাটে-বাসায় নারী শ্রমিকেরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিক-কর্মচারীদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাব্যবস্থা নেই। প্রকৃতপক্ষে শ্রমিক-কর্মচারীরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন, যা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষ একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ চেয়েছিলেন, যেখানে থাকবে না কোনো শোষণ ও নির্যাতন।
বিশ্বব্যাংক আইএমএফের প্রেসক্রিপশনের দিকনির্দেশনায় যে শিল্পনীতি প্রণয়ন করা হচ্ছে, তার ফলে দেশীয় শিল্প গড়ে ওঠার পরিবর্তে বহুজাতিক করপোরেশনের অবাধ অনুপ্রবেশের ফলে দেশীয় বাজার বিদেশি পণ্যে সয়লাব হয়ে পড়েছে। গড়ে উঠছে এক পরগাছা অর্থনীতি, যে অর্থনীতি কোনো দিনই স্বাবলম্বিক অর্থনীতি গড়ে উঠতে পারে না।
তাই দেশকে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত করার সঙ্গে সঙ্গে শ্রমজীবী মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে শোষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয় নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। এটাই হোক এবারের মহান মে দিবসের প্রত্যয়।
ওয়াজেদুল ইসলাম খান: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র।

No comments

Powered by Blogger.