শিক্ষা-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির নিয়ম by তুহিন ওয়াদুদ

প্রতি বছর একজন বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার্থীকে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেওয়ার পর ওই দিনই আবার অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটতে দেখা যায়। যাতে তাদের এ হয়রানি কম হয় সেজন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরীক্ষার জন্য সম্মিলিত আলোচনার মাধ্যমে ভর্তি পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করা প্রয়োজন। প্রতি বছর ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা অমানবিক

ছোটাছুটির মধ্যে থাকে। যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যৌথ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ভর্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করে তা হলে শিক্ষার্থীদের অনেক সময় এবং অর্থ সাশ্রয় হবে। অনিবার্য কোনো কারণে যদি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা পিছিয়ে যায় তবে তা সব পরীক্ষার পর নেওয়া যেতে পারে। দেশের ভর্তি পরীক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ সাপেক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে পারে। যেমন সবার আগে মেডিকেল, তারপর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এভাবে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দক্রম তৈরি করে থাকে সে অনুযায়ী ভর্তি পরীক্ষা হলে একজন পরীক্ষার্থী তার পছন্দমতো ্বশ্বিবিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেলে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন হবে না। এরই মধ্যে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির তারিখ ঘোষিত হয়েছে। দেশের কয়েক লাখ পরীক্ষার্র্থীর কথা বিবেচনা করে প্রয়োজনে নতুন করে তারিখ নির্ধারণ করা যেতে পারে। এক শহরে যাতে একজন পরীক্ষার্থীকে একাধিকবার যেতে না হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নির্ধারিত আসনের অনেকগুলো আসন শূন্য থাকে। উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণী পাস করার পর দেখা যায় শিক্ষার্থীরা যদি তাদের কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ না পেয়ে থাকে তাহলে তারা যে কোনো একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেলে তারা সেখানে ভর্তি হয়ে থাকে। এরপর শর্ত অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে যতদিন ক্লাস না করলে ছাত্রত্ব বাতিল হবে সেই ক'দিন ক্লাস করে তারা পরবর্তী বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য চেষ্টা করতে থাকে। এ রকম পরীক্ষার্থীর সংখ্যা সামান্য নয়। দেশের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও এ বাস্তবতা লক্ষ্য করা যায়। সেখানে মেডিকেল, প্রকৌশল কিংবা বিষয় পছন্দ না হওয়ার কারণে তারা পরবর্তী বছর আবার চেষ্টা করে থাকে। এ কারণে দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আনুমানিক দশ শতাংশ আসন শূন্য থাকে। এ আসন আর পূরণ করার কোনো উপায় থাকে না। দেশে যেখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লেখাপড়ার সুযোগ অত্যন্ত কম, সেখানে যদি প্রতি বছর দশ শতাংশ আসন শূন্য থাকে তাহলে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। প্রথম বছরে ভর্তি পরীক্ষার আগে অনেকের অনেক সমস্যা থাকায় তাদের ভর্তি পরীক্ষা খারাপ হতে পারে কিংবা ভর্তি পরীক্ষা নাও দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে তাদের দ্বিতীয় বছরে সুযোগ না দেওয়াটা অমানবিক হয়। সে ক্ষেত্রে প্রথম বছর যারা বিশ্ববিদালয়ে ভর্তি হয় সেটা দেশের যে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই হোক না কেন তাদের পরবর্তী বছর আর ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না দেওয়াই উচিত।
উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিযুদ্ধ। এ যুদ্ধে এগিয়ে যাওয়ার জন্য আবার কোচিংয়ের দ্বারস্থ হতে হয়। এ বছর সারাদেশে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন প্রায় সাড়ে সাত লাখ পরীক্ষার্থী। এদের মধ্যে যদি অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী কোচিং করে থাকে এবং গড়ে যদি তাদের প্রতি মাসে থাকা-খাওয়া এবং কোচিং বাবদ উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা-পরবর্তী ছয় মাসে ব্যয় হয় পঁচাত্তর হাজার টাকা, তাহলে চার লাখ শিক্ষার্থীর ছয় মাসে ব্যয় হয় আনুমানিক তিন হাজার কোটি টাকা। এ ব্যয় আরও বেশি ছাড়া কম নয়। এ অর্থের জোগান দেওয়া বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত অভিভাবকদের পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার।
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করা প্রয়োজন। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে তাদের মাধ্যমিক শ্রেণীতে প্রাপ্ত ফলের ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করা যেতে পারে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ইন্টারনেটের মাধ্যমে তারা আবেদন করবে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর তাদের পরীক্ষা কেমন হয়েছে তার ওপর নির্ভর করে তারা ভর্তি পরীক্ষার টাকা জমা দেবে। তাদের ফলের সম্ভাব্যতার ওপর নির্ভর করেই তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক ফল প্রকাশিত হতে পারে। এরপর যখন উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর ফল প্রকাশিত হবে সেই ফলের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে শিক্ষা বোর্ড থেকে শিক্ষার্থীদের ফল সংগ্রহ করে জিপিএ যোগ করে চূড়ান্ত মেধা তালিকা প্রকাশ করবে। ভর্তি পরীক্ষার যোগ্যতা হবে মাধ্যমিকের ফলের ভিত্তিতে। এ কাজ করতে পারলে শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে যে ছয় মাস নষ্ট হচ্ছে তার চার মাস রক্ষা করা সম্ভব হবে। শুধু তাই নয়, প্রতি বছর কোচিংয়ের নাম করে যে তিন হাজার কোটি টাকা অভিভাবকদের ব্যয় করতে হয় তা থেকেও রক্ষা পাওয়া সম্ভব হবে। কোচিংয়ের নামে ব্যয়কৃত অর্থে প্রতি বছর কয়েকটি করে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা সম্ভব। প্রাথমিক অবস্থায় এ প্রস্তাবে চমকে উঠলেও এই প্রস্তাবনার মধ্যে যে যৌক্তিকতা রয়েছে তা আমাদের জাতীয় জীবনে অনেক কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। এ পদ্ধতিতে যে সামান্য শিক্ষার্থী ফেল করবে এবং তুলনামূলক খারাপ করবে। কিন্তু ফল প্রকাশের আগে বুঝতে পারবে না তাদের জন্য ক্ষতি হবে। তবে তিন হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় এবং প্রায় চার মাস রক্ষার জন্য সে ক্ষতি স্বীকার করে নেওয়া যায়।

ড. তুহিন ওয়াদুদ : শিক্ষক, বাংলা বিভাগ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
wdudtuhin@gmail.con
 

No comments

Powered by Blogger.