কনিষ্ঠতম ভাষাসৈনিক হামিদুজ্জামান by একেএম সাইদুজ্জামান

আমার বাবা একেএম হামিদুজ্জামান (এহিয়া) যা করতে পেরেছিলেন তা তিনি করতে পারেননি জীবদ্দশায়। তিনি তার জনতাকে একত্র করতে পেরেছিলেন। 'আমার জনতা'_ বাবার ভাষা এমনধারাই ছিল। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ভাষা আন্দোলনের কারণে কারাবরণ করে তিনিই বস্তুত হয়েছিলেন ইতিহাসে কনিষ্ঠতম ভাষাসৈনিক।

বহু কাঙ্ক্ষিত একটি কলেজের তিনিই ছিলেন মহাপ্রাণ প্রতিষ্ঠাতা। মাগুরা জেলায় নাকোল সম্মিলনী ডিগ্রি কলেজ সদম্ভে আজ তার নাম বহন করছে প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। একটি সড়কের শোভা বাড়াতে আলোকসজ্জার মতো ব্যবহৃত আজ তার নাম। প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ 'ভাষাসৈনিক একেএম হামিদুজ্জামান (এহিয়া) সড়ক' সরাসরি কেষ্টপুর বিশ্বরোড থেকে নাকোল বাজারে গিয়ে মিশেছে। ভাষা আন্দোলন জাদুঘরে তার ছবি সুসংরক্ষিত।
আমার নিজের বয়স যখন ১৬ বছর ছিল, বাবা আমায় তার গল্পটি শোনালেন। বাড়ি থেকে পালিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার গল্প, ভাষা আন্দোলনে জড়িত বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার গল্প। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের নেতৃত্বে আমার বাবা একজন তরুণ, আন্দোলনের ডাক বিতরণ করতে তার হ্যান্ডবিল হাতে বেরিয়েছেন রাজপথে জনসমাজকে জাগিয়ে তুলতে; নিজেকে এবং নিজের ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে। আর একই সঙ্গে গ্রহণ করতে বিক্ষুব্ধতা এবং রাজনৈতিক আন্দোলনের নব এই জীবনের সূচনাক্ষণ। ২৭ ফেব্রুয়ারি বেলুচ রেজিমেন্ট তাকে গ্রেফতার করে। তিনি কারারুদ্ধ হন। পরবর্তী সময়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাঁর যশোর সফরকালে আমার বাবার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তাঁদের দেখা হয়েছিল। নিশ্চয়ই দুই অসম ব্যক্তি বিস্ময়বিমুগ্ধভাবে একে অপরের চোখে চোখ রেখেছিলেন। আমার কলেজে পড়া শেষ হলে আমার বাবা চেয়েছিলেন আমি আইন বিষয়ে পড়াশোনা করি। কিন্তু আমি নিজে চেয়েছিলাম ইঞ্জিনিয়ার হতে। তিনি চেয়েছিলেন আমি বাড়িতেই থাকি। তার পাশে এসে দাঁড়াই, তার মানুষের পাশে এসে দাঁড়াই। এটাই ঠিক আমি যা চাইনি, এটাই ঠিক আমি যা করিনি। আমার দেশত্যাগ সম্পর্কে আমার যে উপলব্ধি ছিল তা হলো, বাবার ইচ্ছা পূরণ না করতে পারলেও দেশত্যাগের সঙ্গে আমার দেশপ্রেম ব্যাহত হওয়ার কোনো আশঙ্কাই নেই। তা ছাড়া স্বদেশকে ভালোবাসা যায় সম্ভবত যতটা দূর থেকে, ততটা নয় কাছ থেকে। আমার বাবার চোখে ভালো লাগেনি আমার মাত্র আঠারো বছর বয়সে দেশ ছেড়ে দীর্ঘমেয়াদি প্রবাস জীবন গ্রহণ করা, তা যতই বিদ্যার্জনের উদ্দেশ্যে হোক না কেন। আমরা কথা বলতাম বস্তুত সব বিষয়েই। তিনি আমাকে তার ভাবনার কথা বলতেন, তার করণীয় তালিকার কথা বলতেন। বলতেন সাফল্যের কথা, ব্যর্থতার কথা, সন্তোষের কথা, আশাভঙ্গের কথা। তিনি আমাকে রাজনীতি বোঝাতে চেষ্টা করতেন, যে সম্পর্কে আমার সে রকম কোনো ধারণাই মূলত ছিল না। তিনি বোঝাতে চাইতেন কী রকম নাটকীয় পরিবর্তন হতে পারত আমাদের দেশে, যদি আমাদের জাতির পিতাকে হনন করা না হতো। তিনি অনিবার্যভাবে আমাকে বোঝাতেন একটি জাতির জন্য তার পিতাকে হত্যা করার অর্থ কী হয়। ২০০৫ সালের শেষ দিকে ফোন করে জানলাম বাবার ক্যান্সার ধরা পড়েছে। তারপর এক সন্ধ্যায় ফোন এলো বাড়ি থেকে। তারা বললেন, বাবা মারা গেছেন।

No comments

Powered by Blogger.