সন্ত্রাসবাদ-ওসামা বিন লাদেনের পর by নিকোলাস ক্রিস্টফ

প্রেসিডেন্ট ওবামা এইমাত্র ঘোষণা করলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করেছে, তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করেছে। নয় বছর সাত মাস আগে লাদেন ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনা ঘটিয়েছিলেন, কিন্তু মার্কিন বাহিনী শেষ পর্যন্ত তাঁকে হত্যা করল। তাঁর দেহ এখন আমেরিকানদের হাতে।

এটা প্রতিশোধ; আবার একই সঙ্গে প্রতিরোধও বটে। এটা করা হলো এই লক্ষ্যে, যেন লাদেন আর কোনো আমেরিকানকে হত্যা করতে না পারেন। আল-কায়েদার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের এটাই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য।
এর অর্থ কী? প্রথমত, লাদেনকে যে শেষ পর্যন্ত নিকাশ করা গেছে, এটা যুক্তরাষ্ট্রের নাম, ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির জন্য ভালো। যুক্তরাষ্ট্রের হাত থেকে লাদেনের পালিয়ে বাঁচার সামর্থ্য, কেউই তাঁর কিছু করতে পারবে না—এমন ভাবমূর্তির বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি দাঁড়িয়েছিল একটা কাগুজে বাঘের মতো এবং সেটা চরমপন্থী সন্ত্রাসবাদীদের মনে উৎসাহ জোগাত। লাদেন নিজেই একবার বলেছিলেন, লোকে সেই ঘোড়ার পক্ষে বাজি ধরে—যে ঘোড়া জোরে ছোটে, যে ঘোড়া শক্তিশালী, যে ঘোড়া জিতবে। এখন লাদেনকে হত্যা করার পর সেই ঘোড়াটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যার পক্ষে বাজি ধরা যায়। এ ছাড়া এই ঘটনার বার্তা হচ্ছে, আমেরিকার সঙ্গে ঝামেলায় যেয়ো না, বিনাশ হয়ে যাবে; আমেরিকার ওপর আক্রমণ চালালে তার পরিণতি ভোগ করতে হবে।
কিন্তু লাদেনকে হত্যা করার মানে আল-কায়েদার পরিসমাপ্তি নয়। এর দ্বিতীয় নেতা মিসরীয় নাগরিক আয়মান আল-জাওয়াহিরি অনেক দিন ধরেই চিফ অপারেটিং অফিসার হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে আসছেন। আল-কায়েদা যতটা না একটি দৃঢ়বদ্ধ একক সংগঠন, তার চেয়ে বেশি একটি নেটওয়ার্ক—সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটা আরও স্পষ্ট হয়েছে। উত্তর আফ্রিকায় আল-কায়েদার একটি ধরন হচ্ছে একিউআইএম (আল-কায়েদা ইন মাগরেব), মালি ও মৌরিতানিয়ার মতো দেশগুলোর জন্য এই সংগঠন সত্যিকারের এক বিপদ। লাদেনের হত্যার কোনো প্রভাব সেখানে আদৌ পড়বে বলে মনে হয় না। একিউআইএমের সন্ত্রাসীরা লাদেনের ভক্ত হতে পারে, তাঁর দ্বারা অনুপ্রাণিত হতে পারে, কিন্তু তারা লাদেনের ওপর নির্ভরশীল নয়। এ ছাড়া ইয়েমেনে আছেন আনওয়ার আল-আওয়ালাকি, আল-কায়েদার সঙ্গে যাঁর সম্পর্ক, লাদেনের হত্যাকাণ্ডের ফলে তিনি মোটেও দমে যাবেন না।
অবশ্য এটা ঠিক যে, ২০০২ বা ২০০৩ সালের দিকে লাদেন মারা গেলে তার প্রভাবটা এখনকার চেয়ে বেশি হতো। সেই সময় পাকিস্তানের মতো অনেক দেশে বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ লাদেনকে বেশ শ্রদ্ধার চোখে দেখত, তারা বিশ্বাস করত না যে লাদেনই ছিলেন আমেরিকায় ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পেছনের মূল লোক। ধীরে ধীরে সে দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে; অনেক মানুষ তাঁর বিরুদ্ধে চলে গেছে; তাঁর ছবিওয়ালা টি-শার্ট আজকাল আর বিক্রি হতে দেখা যায় না। অবশ্য তাঁর আমেরিকাকে আঘাত করার সামর্থ্যের কথা ভেবে অনেক মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধা করে, বা তারা এতই আমেরিকাবিদ্বেষী যে আমেরিকার শত্রু যেকোনো ব্যক্তিকে তারা বুকে জড়িয়ে ধরতে চায়। কিন্তু এটা ঠিক যে লাদেনের জনপ্রিয়তা গত কয়েক বছরে ভীষণভাবে কমে গেছে।
লাদেনের এই ক্ষয়ে যাওয়া ভাবমূর্তির অর্থ এই যে অনেক মহলে তিনি শহীদ বলে গণ্য হবেন না (তবে আমেরিকানরা যদি লাদেনের মৃত্যুতে বাড়াবাড়ি রকমের বিজয়োল্লাসে মেতে ওঠে, তাঁর কবরের ওপর নাচানাচি করে, তাহলে তার পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় লাদেনের পক্ষে কিছু সহানুভূতি দেখা দিতে পারে।); লাদেনের মৃত্যুর খবরে অনেক পাকিস্তানি, ইয়েমেনি ও আফগান স্রেফ কাঁধ ঝাঁকিয়ে নিজের কাজে চলে যাবে। তাঁর মৃত্যু এখন মানুষকে সেভাবে অনুপ্রাণিত করবে না, ২০০২ সালের দিকে যেভাবে করতে পারত। আর আল-কায়েদার জন্য তো কঠিন সময় যাচ্ছে; আরব বিশ্বের গণজাগরণ তাদের এক পাশে সরিয়ে দিয়েছে। সর্বোপরি শীর্ষ নেতাকে হারানো আল-কায়েদার জন্য এক বিরাট আঘাত।
ভাবছি, পাকিস্তানের মাটিতে এই আমেরিকান সামরিক অভিযানের ব্যাপারে পাকিস্তানের জনগণের প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে। প্রেসিডেন্ট ওবামা খুব জোর দিয়ে বললেন, লাদেন যেমন আমেরিকার শত্রু ছিলেন, তেমনই শত্রু ছিলেন পাকিস্তানেরও। তাঁর শঙ্কা, পাকিস্তানিরা তাদের মাটিতে আমেরিকান সামরিক অভিযানে ভীষণ খেপে উঠতে পারে। ওবামা আরও বলেছেন, গত বছরের আগস্ট মাসে তিনি জানতে পেরেছিলেন যে লাদেন পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদের একটি ভবনে থাকতে পারেন। তথ্যটি সঠিক কি না, তা যাচাই করে দেখতে বেশ সময় লেগেছে; মাত্র গত সপ্তাহে তিনি এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন এবং সেখানে অভিযান পরিচালনার আদেশ দিয়েছেন। আজ সেখানে আক্রমণ চালিয়েছে আমেরিকান বাহিনী (সম্ভবত সিআইএ বা বিশেষ বাহিনী); গোলাগুলি বিনিময়ের পর লাদেন নিহত হয়েছেন এবং তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। একবার লাহোরে সিআইএর এক অভিযানের সময় পাকিস্তানিদের ওপর গুলিবর্ষণের পর রেইমন ডেভিস নামের যে আমেরিকানকে পাকিস্তান গ্রেপ্তার করেছিল, লাদেনের ওপর আজকের আক্রমণের সঙ্গে তিনি সম্ভবত জড়িত এবং সেটাই হয়তো তাঁর কর্মকাণ্ডের গোপন স্বভাবের কারণ। এবং এটাও অবশ্যই একটা প্রশ্ন যে লাদেন আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে কী করে এলেন, পাকিস্তানিরা সে সম্পর্কে কিছু জানত কি না। পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ সব সময় আমাকে ও অন্য সাংবাদিকদের বলেছেন যে লাদেন পাকিস্তানে নেই, আফগানিস্তানে আছেন। এমনকি তিনি এমন সম্ভাবনার কথাও বলেছিলেন যে লাদেন মারা গেছেন।
একটা প্রশ্ন হচ্ছে, লাদেনের হত্যাকাণ্ড থেকে এমন গোয়েন্দা তথ্য পাওয়া যাবে কি না, যা জাওয়াহিরিসহ আল-কায়েদার অন্যান্য নেতা ও যোদ্ধাকে পাকিস্তানে বা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ধরার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। সন্ত্রাসবাদীদের অর্থায়নের নেটওয়ার্ক সম্পর্কেও জানা যেতে পারে। লাদেনের ল্যাপটপের সব তথ্য হাতে পাওয়া গেলে কী হতে পারে, কল্পনা করে দেখুন।
এখন আল-কায়েদার দিক থেকে কি পাল্টা আঘাত আসবে? আসতে পারে। কিন্তু সে তো নতুন কিছু নয়, তারা তো আমেরিকার ওপর হামলা চালানোর চেষ্টা করেই আসছে। কখনো যে একটু সংযম দেখিয়েছে, তা তো নয়। বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, আফগানিস্তান-পাকিস্তান অঞ্চলে আল-কায়েদাকে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া। তা যদি সম্ভব হয়, তাহলে কারজাই সরকার ও তালেবানদের মধ্যে একটা সমঝোতার মাধ্যমে আফগানিস্তানে যুদ্ধের অবসান ঘটানো সহজ হয়ে আসবে। তালেবান নানা দিক থেকে বিপজ্জনক হলেও তারা নিজেদের অঞ্চল নিয়েই ব্যস্ত, আল-কায়েদার যোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়া ছাড়া বিদেশি জঙ্গিদের সঙ্গে তালেবানের যোগাযোগ তেমন নেই। লাদেনের মতো বিদেশি জঙ্গিদের যদি ওই অঞ্চল থেকে হটিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে কারজাই সরকারের সঙ্গে তালেবানের একটা কার্যকর সমঝোতা চুক্তি হতে পারে।
অবশ্য আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে তালেবানদের আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ দেওয়ায় অনেক ধরনের প্রশ্ন উঠেছে; বিশেষ করে, নারীদের ওপর তালেবানি শাসনের প্রভাব নিয়ে। পুরো দেশে তাদের ভূমিকা হবে আফগান নারীদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। আবার যুদ্ধও তাদের জন্য একই রকম বিপর্যয়কর। এমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে তালেবানরা নারীদের ক্ষেত্রে কিছু নীতিগত বিষয়ে ছাড় দিতে চায়; বিশেষ করে, মেয়েশিশুদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার অনুমতি তারা দেবে। এ সবকিছুই আলোচনার মাধ্যমে আদায় করে নিতে হবে।
লাদেনের মৃত্যু প্রেসিডেন্ট ওবামার রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ওপর কি প্রভাব ফেলবে? আমার মনে হয় না তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে। ২০১২ সালের নভেম্বর এখনো অনেক দূরে; আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান রাজনৈতিক ইস্যু হবে সম্ভবত অর্থনীতি। আমরা দেখেছি, ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বিজয় জর্জ বুশকে (সিনিয়র) নায়ক বানিয়েছিল, কিন্তু ১৯৯২ সালের নভেম্বরে বিল ক্লিনটনের কাছে তিনি হেরেছিলেন অর্থনৈতিক মন্দার কারণে।
নিউইয়র্ক টাইমস ডটকম থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মশিউল আলম
নিকোলাস ক্রিস্টফ: নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.