বিতর্ক হোক সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে-সংসদে দুই নেত্রী

বিগত তিন বছরের মধ্যে গত মঙ্গলবার সংসদে দুই নেত্রীর উপস্থিতি ও পরস্পরের প্রতি সহনশীল মনোভাবের এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো। বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এক ঘণ্টা ৫৩ মিনিট বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর বক্তব্যের সময় কোনো কটুবাক্য তিনি উচ্চারণ করেননি।

অন্যদিকে, সংসদে সরকারদলীয় সদস্যদের বিপুল সংখ্যাধিক্য সত্ত্বেও তেমন হইচই বা অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়নি। বিগত কয়েক বছর বিএনপির সংসদ অধিবেশন বর্জনের পটভূমিতে এবারের অধিবেশন সেদিক থেকে উৎসাহিত হওয়ার মতো।
সংসদ নেত্রী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে বিরোধীদলীয় নেত্রীর বক্তব্য খণ্ডন করেছেন। তিনি মাত্র ৪৯ মিনিট বক্তব্য দিয়েছেন, যা ছিল সুবিবেচনাপ্রসূত। প্রধানমন্ত্রী সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচি তুলে ধরার পাশাপাশি বিরোধীদলীয় নেত্রীর অভিযোগেরও জবাব দিয়েছেন।
লক্ষণীয় যে দুই নেত্রীই তাঁদের ভাষণে স্বভাবসুলভ আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার করতে দ্বিধা করেননি। প্রশাসন দলীয়করণ থেকে শুরু করে বিরোধী দলের সমাবেশে বাধাদান, বিদ্যুতের বেহাল—কোনোটাই বিরোধীদলীয় নেত্রীর বক্তব্যে বাদ যায়নি। ‘কুইক রেন্টালের কারণে পাওয়ার কুইক হচ্ছে না, মানি কুইক হচ্ছে’—এই চাতুর্যপূর্ণ বক্তব্যে যেমন সত্যতা আছে, তেমনি আছে সূক্ষ্ম খোঁচা। কিন্তু এ ধরনের বক্তব্য খণ্ডন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী কথার তীক্ষতা তীব্রতর করেননি, আবার সাবলীল ভঙ্গিতে কঠোর ভাষায় বিরোধী দলকে উদ্দেশ করে কথা বলতেও ছাড়েননি। তিনি বিএনপিকে মনে করিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কোর্ট ও সিঙ্গাপুরের আদালতে তাদের দুর্নীতির প্রমাণ আছে।’ বিরোধী দলের সমালোচনায় প্রধানমন্ত্রীও যুক্তির মধ্যে থেকেই কৌশলী বক্তব্য দিয়েছেন।
বিরোধীদলীয় নেত্রী সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না, হতে দেওয়া হবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের জন্য তিনি সরকারকে সমঝোতার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের আহ্বান জানান। এটাও যথেষ্ট যুক্তিপূর্ণ অবস্থান। বিপরীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিষয়টি আলোচনায় উল্লেখ করেননি। অর্থাৎ এ উত্তপ্ত বিষয়টি এক কথায় নাকচ করা থেকে তিনি বিরত থেকেছেন, যা এর আগের অবস্থান থেকে কিছুটা আলাদা। প্রধানমন্ত্রীর এই অবস্থান রাজনৈতিক দূরদর্শিতার প্রমাণ বহন করে।
সংসদ হলো জাতীয় সমস্যাগুলো নিয়ে সুস্থ বিতর্কের আদর্শ স্থান। এখানে সব বিষয়ে খোলামেলা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে আলোচনা হতে হবে। মিয়ানমারের কাছ থেকে সমুদ্রের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সফল হওয়ায় বিরোধীদলীয় নেত্রী শুধু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীকেই নয়, প্রধানমন্ত্রীকেও শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন, ‘সরকারের ভালো কাজে সমর্থন দেব, খারাপ কাজের সমালোচনা করব।’ এ মনোভাবের বিপরীতে বলা দরকার, সংসদে থাকুন, গঠনমূলক সমালোচনা করুন। সরকারি দলেরও কর্তব্য হবে বিরোধী দলের যুক্তিপূর্ণ সমালোচনাকে আমলে নেওয়া। অন্তত তাদের বক্তব্যে বাধাদান না করা। দুই পক্ষের এ সহিষ্ণু ও সহযোগিতার ওপরই সংসদের কার্যকারিতা অনেকাংশে নির্ভর করে।

No comments

Powered by Blogger.